ছবির কথা, কথার ছবি; সময়ের হিরো শিশু নাঈম

প্রকাশিত: ৬:২৬ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৯, ২০১৯

শাহনূর শাহীন
কবি ও সংবাদকর্মী

বনানীতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর থেকেই ছোট একটি শিশুর ছবি ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এক দুই তিন করে হাজার হাজার ফেসবুক প্রোফাইল হতে থাকে থাকে সেই ছবি।

অগ্নিকাণ্ডের পর হাজারো উৎসুক জনতা যখন আগুনের বিভৎসা দেখছিলো, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা যখন আগুন নিভানোর কাজ করছিলো ঠিক সেই সময়ে ছোট্ট এই শিশুটি ফায়ার সার্ভিসের পানি ছিটানোর একটি পাইপের ফুটোতে পলিথিন দিয়ে পানি বেরিয়ে যাওয়া আটকানোর চেষ্টা করছিলো।

শিশুটির পরিচয় পাওয়া গেছে। ছেলেটির নাম মো. নাঈম ইসলাম। বয়স ৮ বছর। সে মা-বাবার সাথে বনানীর কড়াইল বস্তিতে থাকে। ব্রাকের আনন্দ স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে।

ছবিতে দেখা যায় একটি পাইপের ফুটো দিয়ে পানি বের হওয়ায় সেই ফুটোতে পলিথিন মুড়িয়ে বসে আছে শিশু নাঈম ইসলাম। গতকাল বিকেল থেকেই এই ছবিটি ফেসবুকে ভাইরাল হতে থাকে।

বিভিন্নজন তাদের ফেসবুক টাইমলাইনে ছবিটি শেয়ার করে উৎসাহ ব্যাঞ্জন ক্যাপশন দিয়ে নাম না জানা নাঈমের প্রশংসা করছিলো। অনেকেই তাকে হিরো আখ্যায়িত করে ফেসবুকে পোস্ট করে।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিমন্ত্রী জোনায়েদ আহমেদ পলকও আজ তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে ছবিটি শেয়ার করে একটি পোস্ট করেছেন। মন্ত্রী পলকও শিশু নাঈমকে হিরো আখ্যায়িত করে পোস্ট করেছেন।

ফেসবুকে হাবিব জিহাদী নামে একজন ছবি শেয়ার করে লিখেছেন, ‘হাজারো খলনায়কদের ভিড়ে একজন রিয়েল হিরো….. স্যালুট ও ভালোবাসা’। হ্যাশ ট্যাগ দিয়ে মো: নয়ন চৌধুরী লিখেছেন  ‘পিকচার অফ দ্যা ডে’।

‘বাঙালি সব দোষ রাজনীতবিদদের উপর চাপিয়ে দিতে শিখেছে, নিজে প্রতিবাদ করতে শিখেনি। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের ঘোষণার অপেক্ষায় আন্দোলন করতে প্রস্তুতি নিতে শিখেছে নিজে কিছু করতে শিখেনি। শিখেনি ন্যায় সঙ্গত প্রতিবাদে মুখ খুলেতে। 

এখন থেকে শুরু হোক প্রতিবাদ। যেখানে অনিয়ম সেখানেই প্রতিবাদ। যেখানে অব্যস্থপনা সেখানেই সাধ্য হলে নিজের হাত লাগানো। মুখ বুঝে ঝোঁপ বুঝে সমালোচনা বন্ধ হোক। দায়িত্বশীল হয়ে উঠুক দেশের প্রতিটি নাগরিক’।

তবে ছেলেটির প্রশংসা করার পাশাপাশি কিছু অব্যবস্থাপনার সমালোচনাও করেছেন কেউ কেউ। ছবিটি শেয়ার করে সাব্বির জাদিদ লিখেছেন, এই ছেলেটার প্রশংসা করুন, সাথে ফায়ার সার্ভিসের পাইপ কেন ফুটো, সেই প্রশ্নটাও তুলুন। তবে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও আন্তরিকতারও প্রশংসা করেছেন অনেকে।

এই একটি ছবির প্রশংসায় হাজারো মানুষ নিজেদের টাইমলাইনে অভিব্যক্তি জানানোর পাশাপাশি আরো একটি ছবি শেয়ার করে তীব্র সমালোচনাও করেছেন অনেকে।

সমালোচনার শিকার ওই ছবিটিতে দেখা যায় হাজার হাজার মানুষ অগ্নিকাণ্ডের শিকার এফআর টাওয়ারে সামনে জড়ো হয়ে উদাস ভঙিতে চেয়ে আছেন আকাশের দিকে। কেউ শুধু হা করে তাকিয়ে আছে কেউ বা আার হাতে থাকা মোবাইল ফোনে ভিডিও করছেন অগ্নিকাণ্ডের দৃশ্য।

ফাইজুল ইসলাম নামে একজন ছবিটির ক্যাপশনে লিখেছেন, ‘শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর লর্ডক্লাইভ বলেছিলো, যেদিন আমরা শেষ নবাবকে আটক করে নিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন যতজন বাঙালি তামাশা দেখছিলো যদি ১টি করে ছোট পাথর নিয়ে তাড়া করতো আমরা হেরে যেতাম। বাঙালি ঐতিহাসিকভাবেই ১টি তামাশা দেখা জাতি, ফায়ার বিগ্রেড, এম্বুলেন্সের পথ আটকে তারা তামাশা দেখছে’।

‘দুটি ছবির কথা ধরা যাক। একটি ছবি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে স্বদিচ্ছা এবং সুবুদ্ধিসম্পন্ন জ্ঞান থাকলে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র হলেও যে কারো প্রাণ বাঁচাতে সহায়ক হতে পারে।

অপর ছবিটি যেন মুখ গোমরা করে বলে দেয়- সুঠোম দেহের অধিকারী আর শারীরিকভাবে সুস্থ সবল হলেই বিপদগ্রস্থের পাশে দাঁড়ানো যায় না। এর জন্য প্রয়োজন হয় একটি সচেতন বিবেক যা আমাদের অধিকাংশের নেই’।

হাজার হাজার মানুষ উৎসুক হয়ে তাকিয়ে থেকে কী লাভ? আফসোস করেই কী লাভ? যদি না সামান্যতম কারো উপকারে না আসা যায়। এই মানুষগুলোই দিনশেষে সরকারে চৌদ্ধগুষ্ঠি উদ্ধার করবে। অথচ এরাই উদ্ধার কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিতে ভুমিকা রেখেছে।

এরাই আবার চায়ের দোকানে বসে দেশ সেরা বুদ্ধিজীবির ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বিচার বিশ্লেষণ শুর করবে। ব্যাখ্যা করতে থাকবে আগুন লাগা ওই ভবনটি তৈরিতে কোথায় কোথায় অনিয়ম হয়েছে। কে বা কারা এর জন্য দায়ী তাও বলে দেবে ওই লোকগুলো।

এরা ভুলে যায় সমাজে এদেরও কিছু দায়িত্ব আছে। কারো বিপদে-আপদে কিংবা দূযোর্গে এদেরও কিছু করার থাকে সেটা এরা বেমালুম ভুলে যায়। আসলে ভুলে যায় না; বরং এরা কখনো এসব মনেই করে না।

কিছু লোক এমন আছেন যারা ঘরে বসে ফেসবুকে পোস্ট করে কর্তৃপক্ষের সমালোচনায় ব্যস্ত থাকেন। নির্দিষ্ট কাউকে টার্গেট করে বিষাক্ত বাক্য ছুড়ে দেন। তারা চিন্তা করে না- পুরো সমাজাটাই গুণে ধরে আছে। আর এই সমাজের একজন সদস্য হিসেবে প্রত্যেক সমালোচকও দায়ী তাও তারা ঘুণাক্ষরেও টের পান না।

সংবাদ মাধ্যমগুলোতেও নতুন কোনো ইস্যু আসার আগ পর্যন্ত অগ্নিকান্ডে ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ান বর্ণনার পাশাপাশি এফআর টাওয়ার নির্মাণে অনিয়মের চিত্র তুলে ধরে প্রতিবেদন করবে।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও বিভিন্ন স্তরের কর্তা ব্যক্তিরাও ‘কাউকে ছাড় দেয়া হবে না’ ‘এর শেষ দেখে নেয়া হবে’ ‘যতো বড় ক্ষমতাশালী হোক অপরাধী ছাড় পাবে না’ ইত্যাদি ইত্যাদি হুমকি-ধমকিতে ভরপুর বক্তব্য দিবে টেলিভিশনের পর্দায়।

আশপাশের মানুষগুলো ভবন নির্মাতার চৌদ্ধগুষ্ঠি উদ্ধার করবে কেবল চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে। সাহস করে কেউ কলার চেপে ধরে বলতে পারবে না ‘তোমার বিল্ডিংয়ে অগ্নিনিবার্পক ছিলো না কেন’? কেউ বলবে না ‘নিয়ম মেনে ভবন নির্মাণ করোনি কেন’?

ভবন অনুমোদন কর্তৃপক্ষের কাছে কেউ জানতে চাইবে না, ‘এই ভবন বিল্ডিং (বিএনবিসি) কোড না মেনে কিভাবে নির্মাণ হলো’? ‘কর্তৃপক্ষের অগোচরে হয়ে থাকলে পরে আপনার কী করেছেন, কেন তদারকী করেননি’?

কেউ বলবে না এসব। কেন বলবে যারা বলবে তারাই তো খানিক পড়ে ঘুষের টাকা নিয়ে হাজির হবে সেই দপ্তরে নিজের আখের গোছানোর জন্য। কে ব্যবস্থা নিবে? কেন নিবে? যে নিবে তার খাস কামরার কিংবা বেনামি ব্যাংক একাউন্টে একটু পরেই তো কিছু উচ্ছিষ্ট জমা পড়বে!

বাঙালি সব দোষ রাজনীতবিদদের উপর চাপিয়ে দিতে শিখেছে, নিজে প্রতিবাদ করতে শিখেনি। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের ঘোষণার অপেক্ষায় আন্দোলন করতে প্রস্তুতি নিতে শিখেছে নিজে কিছু করতে শিখেনি। শিখেনি ন্যায় সঙ্গত প্রতিবাদে মুখ খুলতে। কিংবা নিজ দায়িত্ব বুঝে নিতে।

‘দুটি ছবির কথা ধরা যাক। একটি ছবি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে স্বদিচ্ছা এবং সুবুদ্ধিসম্পন্ন জ্ঞান থাকলে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র হলেও যে কারো প্রাণ বাঁচাতে সহায়ক হতে পারে।

অপর ছবিটি যেন মুখ গোমরা করে বলে দেয়- সুঠোম দেহের অধিকারী আর শারীরিকভাবে সুস্থ সবল হলেই বিপদগ্রস্থের পাশে দাঁড়ানো যায় না। এর জন্য প্রয়োজন হয় একটি সচেতন বিবেক যা আমাদের অধিকাংশের নেই’।

এখন থেকে শুরু হোক প্রতিবাদ। যেখানে অনিয়ম সেখানেই প্রতিবাদ। যেখানে অব্যস্থপনা সেখানেই সাধ্য হলে নিজের হাত লাগানো। মুখ বুঝে ঝোঁপ বুঝে সমালোচনা বন্ধ হোক। দায়িত্বশীল হয়ে উঠুক দেশের প্রতিটি নাগরিক।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক একুশ নিউজ

/আরএ

Comments