শিশুকে গল্প শোনানোর ১০টি উপকারিতা

প্রকাশিত: ৪:৩৮ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৯

মনে করুন তো শেষ কবে আপনার শিশুকে একটি গল্প শুনিয়েছেন (storytelling)? আপনি নিজে যখন ছোট ছিলেন তখন হয়তো দাদা-দাদি অথবা নানা-নানির কাছে শুনেছেন বহু গল্প।

সেগুলোর অনেককিছু এখনও মনে আছে আপনার; হঠাৎ কখনও কোন সিনেমা দেখতে গিয়ে বা গল্প পড়তে গিয়ে ছোটবেলার কোন গল্পের সাথে মিল দেখে মনে মনে হেসেছেন। আপনার শিশুদের এখন সেই সৌভাগ্য হওয়ার সুযোগ অনেক কম। কিন্তু এজন্য আপনার শিশু কি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তা কি আপনি জানেন?

অভিভাবকরা এখন শিশুদের তার প্রিয় কার্টুনটি স্মার্টফোনে বা টিভিতে দেখিয়ে ঘুম পাড়াতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। বিছানার পাশে শুয়ে বা বসে তাকে ৫-১০ মিনিটের একটি গল্পের বই পড়ে শুনানোর সময় কোথায়? বাসায় গল্পের বই নেই? নিজের ছোটবেলায় দাদা-দাদির কাছে শুনা কোন গল্পই বলুন না। অথবা নিজের স্মার্টফোন থেকে নামিয়ে নিন কিছু গল্প।

আপনার শিশুর বয়স যদি ৩-১০ বছর হয়, এই গল্প পড়ে শুনানোর অভ্যাস (storytelling) বা নিজে নিজে গল্পের বই পড়ার অভ্যাস তাকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে সেটি তবে শুনুন। আপনার দাদা-দাদি বা অন্য যে কেউ যিনি আপনাকে ছোটবেলা গল্প শুনিয়েছে তারা আপনার জীবনে কি উপকার করেছে সেটিও তবে জেনে নিন।

শিশুদের গল্প শুনানোর ১০টি উপকারিতা
১। শিশুদের মধ্যে সৎগুণের বিকাশ ঘটায়
পৃথিবীর সব শিশুই গল্প শুনতে ভালোবাসে। তারা তাদের প্রিয় চরিত্রকে প্রায়ই নকল করতে চায়। যেসব গল্পের শেষে একটি অর্থপূর্ণ মেসেজ থাকে সেগুলো আপনার শিশুর মধ্যে সততা, ন্যায়পরায়ণতা, সৎসাহস, বুদ্ধি বিকাশে সহায়তা করে। আপনার চরিত্র গঠনে আপনার পরিবার, পারিপার্শ্বিকতা ইত্যাদি ছাড়াও আপনি ছোটবেলা থেকে যেসব বই পড়েছেন বা গল্প শুনেছেন তাদের প্রভাবও কিন্তু কম না। আপনি নিজেও সেটা জানেন না।

২। নিজের সংস্কৃতি এবং মূল সম্পর্কে ধারণা দেয়
গত ২০-৩০ বছরে আমাদের দেশ, আমাদের সমাজ এবং সংস্কৃতি কত বদলে গেছে। আপনার নিজের ছোটবেলার গল্প আপনার শিশুকে বলুন অথবা আপনার বাবা-মার সময়ের গল্প। কুলা, ঢেঁকি, পালকি কি জিনিস সেটা কি জানে আপনার শিশু? শীতের পিঠা, নবান্ন উৎসব আর গ্রামীণ মেলার সেইসব আনন্দময় স্মৃতিগুলো থেকে কেন বঞ্চিত করবেন আপনার শিশুকে?

‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’ – ভেবে কষ্ট না পেয়ে সেই দিনগুলোর কথা আপনার শিশুর সাথে শেয়ার করুন। এতে করে তার নিজের সংস্কৃতি, নিজের সমাজ এবং মূল সম্পর্কে শক্ত ধারণা হবে। অনেক অভিভাবকদের কষ্ট যে তাদের সন্তানরা বিদেশ যেয়ে নিজ সংস্কৃতি ভুলে বিদেশি স্টাইলে চলা শুরু করেছে। সেই কষ্ট যদি সহ্য না করতে পারেন বা চান তবে সন্তানদের মধ্যে নিজের সংস্কৃতি সম্পর্কে ভালো ধারণা দিন।

৩। শিশুদের মধ্যে ভাষার দক্ষতা বাড়ে
আপনার শিশু স্কুলে ভালো করুক এটা চান তো নাকি? তাহলে ২-৩ বছর বয়স থেকেই তাকে গল্প পড়ে শুনান। নতুন নতুন শব্দ এবং তাদের উচ্চারণ শিখে ফেলবে দ্রুত। স্কুলে ভর্তি করিয়ে প্রথম বছরই দেখবেন আপনার শিশু অনেকের চেয়ে এগিয়ে। আর একটা কথা, গল্প পড়ে শুনানোর দায়িত্ব কিন্তু খালি মায়ের না, বাবারও। গবেষণায় দেখা গেছে যেসব শিশুরা বাবা এবং মা দুজনের কাছেই গল্প শুনে তারা বেশি শব্দ শিখে এবং ভাষার উপর দখল ভালো হয় যারা কেবল বাবা অথবা মায়ের থেকে গল্প শুনে। কারণ বাবারা (পুরুষরা) যখন গল্প শুনান তখন মায়েদের (মেয়েদের) থেকে ভিন্ন ধরণের শব্দ এবং বাক্য ব্যাবহার করেন। ব্যাপারটি বেশ মজার, তাই না?

৪। শিশুদের মধ্যে শোনার দক্ষতা বাড়ে
শিশুরা সাধারণত খুব কম সময় মনোযোগ ধরে রাখতে পারে। তারা কোনকিছু শোনার চেয়ে বলতেই বেশি ভালোবাসে। কিন্তু যখন শিশুদের আপনি গল্প পড়ে শুনাবেন তখন আস্তে আস্তে তার মধ্যে আগ্রহ নিয়ে শোনার এবং শুনে বোঝার চেষ্টা বাড়বে আর একই সাথে তার মধ্যে মনোযোগ দেয়ার প্রবণতা বাড়বে।

তাই শিশুকে যদি মনোযোগী করতে চান এখন থেকেই একটি করে গল্প পড়ে শুনান। বাচ্চা কথা শুনে না, অনেক দুষ্টু, হাইপার একটিভ, কোন কিছুতে মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না – এইসব কমন সমস্যাগুলো যদি এড়াতে চান বা কমাতে চান এখন থেকেই গল্পের বই পড়ে শুনান আর আস্তে আস্তে বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করুন আপনার শিশুর মধ্যে।

৫। ক্রিয়েটিভিটি এবং কল্পনাশক্তি বাড়ায়
এটি আপনিও জানেন, আমরাও জানি। আপনি হয়তো ভাবতে পারেন, এইসব কল্পনাশক্তি আর ক্রিয়েটিভিটি দিয়ে কি হবে? আমার সন্তান তো আর লেখক বা আর্টিস্ট হবে না। আচ্ছা, না বানালেন আর্টিস্ট, লেখক, অভিনেতা… ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চান তো অন্তত?

ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের রিপোর্ট বলছে, যেসব শিশু এখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ছে তাদের মধ্যে ৮০% শিশু ভবিষ্যতে এমন একটি চাকরিতে ঢুকবে যেটি এখনও দুনিয়াতেই নেই। ভবিষ্যতের সেইসব ঢুকতে হলে যেসব স্কিল দরকার তার মধ্যে এক নাম্বারে হল ক্রিয়েটিভিটি।

আর ভালো কথা, যদি মনে করেন যে এনিমেশন বা কার্টুনও তো বাচ্চার কল্পনাশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে – তাহলে ১০০% ভুল ভাবছেন। শিশুদের কল্পনাশক্তি বাড়ানোর জন্য গল্পের বইয়ের চেয়ে ভালো জিনিস আজ পর্যন্ত মানবজাতি আবিষ্কার করে নাই।

৬। গল্পের বই স্মৃতিশক্তি বাড়ায়
একটু চালাকি যদি করেন তাহলে গল্পের বই শুনানর মাধ্যমে আপনার শিশুর স্মৃতিশক্তিও একটু বাড়িয়ে নিতে পারেন। একটি গল্প শুনানোর পরে প্রশ্ন করে দেখুন আপনার শিশু পুরো গল্পটি বুঝতে পেরেছে কিনা। পরের দিন আবার গল্পটি শুনান। এরপরের দিন তাকেই বলতে বলুন। এভাবে একের পর এক গল্প শুনিয়ে তার কাছ থেকেই আবার শুনে নিন। এতে করে আপনার শিশুর স্মৃতিশক্তি তো বাড়বেই পাশাপাশি তার মনোযোগ দেয়ার ক্ষমতাও বাড়বে।

শিশুকে স্কুলের পড়াশুনায় ভালো করাতে চান, অল্প বয়স থেকেই তার হাতে গল্পের বই তুলে দিন।

৭। আপনার শিশুর চিন্তার প্রসার ঘটায়
পৃথিবীটা মস্ত বড়। কত কত দেশ, সংস্কৃতি, মানুষ। ছোট্ট একটি বইয়ের এক একটি পাতা আপনার শিশুর সামনে খুলে দিতে পারে এক একটি জাতির বা সংস্কৃতির অদেখা জগত। গল্পের বই আপনার শিশুকে একটি দেশের গণ্ডি থেকে বের করে নিয়ে করে তুলতে পারে পৃথিবীর একজন নাগরিক হিসাবে।

৮। পড়াশুনাকে করে দেয় আরও সহজ
ছোটবেলায় পড়ার বইয়ের আড়ালে গল্পের বই বা কমিকস পড়ার জন্য মার খেয়েছেন? আপনার অভিভাবকরা হয়তো না বুঝেই বকা দিয়েছেন বা মার দিয়েছেন। কিন্তু আপনি আমি তো বুঝবান। তবে জেনে রাখুন – গল্পের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন আপনার শিশুর মধ্যে যদি তার স্কুলের জীবনকে একটু সহজ করতে চান। অনেক শিশু না বুঝে মুখস্ত করে, গল্পের বই পড়ার অভ্যাস থাকলে সে ছোটবেলা থেকেই বুঝে শেখার চেষ্টা করে। ইতিহাস, ভূগোল বা রসায়নের মত বোরিং বিষয়গুলো অনেকসময় গল্পের মাধ্যমে মজার করে এবং ভালোভাবে শেখার সুযোগ করে দেয়।

৯। কমুনিকেশন স্কিল বাড়ায়
যদিও শিশুর মনে হাজারো প্রশ্ন কিলবিল করতে থাকে কখনও কখনও তারা প্রশ্ন করতে দ্বিধাবোধ করে। এটি বিশেষ করে যখন সে প্রশ্ন করে উল্টা বকা খায় বা তার প্রশ্নের জবাব কেউ দেয় না তখন এই সমস্যাগুলো তৈরি হতে থাকে। স্টোরিটেলিং বা গল্পবলা শিশুকে সঠিক প্রশ্ন করার ক্ষমতা তৈরি করে দেয়। এর মাধ্যমে শিশুরা চমৎকার কথোপকথন করার সুযোগ তৈরি করে দেয় এবং তাদের কনফিডেন্স বাড়াতে সাহায্য করে। নিয়মিত গল্পের বই পড়া ও গল্প শোনা একজন শিশুকে ভালো বক্তা হতেও সাহায্য করে।

ফিনল্যান্ডের স্কুলগুলোতে শিশুদেরকে গল্পের বই পড়া এবং গল্পের বই পড়ে শিশু নিজে কি বুঝল সেটি নিজে নিজে বলা – এই দুটি বিষয় নিয়ে আলাদা সময় বরাদ্দ করা থাকে।

১০। কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সাহায্য করে
এখন ভাবছেন আমি বাড়িয়ে বলছি? কিন্তু একটু ভাবুন তো শিশুদের গল্পগুলো আসলে কেমন হয়। গল্পের চরিত্র সাধারণত কোন বিপদে পরে এবং বুদ্ধি খাটিয়ে বা অন্য কোনোভাবে সেই কঠিন সমস্যা থেকে বের হয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকে। গল্পের এই চরিত্রগুলোর সমস্যা, সমস্যার সাথে যুদ্ধ করে তা থেকে বের হওয়ার এই ব্যাপারগুলো আপনার শিশুকে এই মেসেজটি দেয় যে জীবন মানে কেবল আনন্দ আর ফুর্তি না। দুঃখ-কষ্ট এবং সমস্যা জীবনের একটি অংশ। সঠিক গল্পের বই আপনার শিশুকে জীবনের নানা সমস্যা মোকাবেলার জন্য তৈরি করে দেয় আপনার এবং আপনার শিশুর অজান্তেই।

Comments