বিনোদনের উদ্যানগুলোতে অশ্লীলতার হাতছানি !

প্রকাশিত: ১:৩৮ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৯, ২০১৮

আল হামজা, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক :  ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী । বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল ও ব্যস্তময় নগরীর অন্যতম ৷ এখানকার মানুষেরা একটু ছুটি বা অবসর পেলেই বিভিন্ন পার্ক বা উদ্যানে ঘুরতে যান প্রকৃতির সান্নিধ্য লাভের আশায় ! এই কর্মব্যস্ত যান্ত্রিক শহরের বিশাল বিশাল দালান-কোঠার মধ্য থেকে কিছুটা সময় খোলা আকাশের নিচে কাটানোর জন্য ছুটে চলেন সবুজের সমারোহ রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী ও চন্দ্রিমা উদ্যানে কিংবা বোটানিকেল গার্ডেনে । তাদের জন্য সেই পার্ক বা উদ্যানগুলো এখন অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠছে । স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে-মেয়েরা সকাল থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত পার্কের মধ্যে নানান অশ্লীল কাজে লিপ্ত হয়ে থাকে। আড়াল ও ছাতার নিচেই শিক্ষার্থীরা অশ্লীলতার নিরাপদ স্থান হিসেবে বেঁচে নেয়।

রাজধানীর পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্রগুলো এখন অপরাধী চক্রের দখলে। মাদকাসক্ত, ছিনতাইকারী ও ছিন্নমূল মানুষের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এদের অবাধ বিচরণের কারণে বিনোদন স্পটগুলোতে দর্শনার্থী কমে যাচ্ছে।

চন্দ্রিমা উদ্যানে ওরা কারা ?

মঙ্গলবার (২৭ মার্চ ) সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়,  ঢাকার  চন্দ্রিমা উদ্যান, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বোটানিকেল গার্ডেন বিনোদনের জন্য তৈরী হলেও এখানে চলছে অসামাজিক কার্যকলাপ। অশ্লীল কার্যকলাপে মগ্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। তাদের কাছে যেন কিছু মনেই হচ্ছে না। এই সমস্ত অশ্লীল কাজ আমাদের সভ্য সমাজের উন্নতির অন্তরায় ! তারা এ কাজ করার জন্য একটু আড়াল ও ঝোপ বেছে নেয়। কেউ কেউ আবার প্রকাশেই একে- অপরকে চুমু খাওয়ায় মহা ব্যস্ত, একে-অপরকে ঝাপটি মেরে ধরে বসে থাকে। তাদের কাছে যেন কিছু মনেই হচ্ছে না। পাশে কেউ বসা আছে বা পাশ দিয়ে কেউ যাচ্ছে। তারা এখানে আসে শুধু অনৈতিক কাজ করার জন্য।

অন্যদিকে যারা ছুটির দিনে বা কর্মব্যস্ত যান্ত্রিকতাকে ভুলতে এক চিলতে সবুজের সান্নিধ্য লাভের জন্য প্রাণ ভরে সতেজ অক্সিজেন গ্রহণ করতে এই স্থান গুলোতে আসেন তারা বর্তমানে এই সমস্ত ছেলে মেয়েদের অশ্লীল কর্মকান্ড দেখে আর আসছে না ।

চন্দিমা উদ্যান বা জিয়া উদ্যান ৷ সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাজার এখানেই অবস্থিত ৷ চন্দ্রিমা উদ্যানটি দর্শনার্থীদের কাছে বিনোদনের আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে পরিচিতি পাওয়ায় দিন দিন এর দর্শনার্থী সংখ্যাও বাড়তে থাকে। সেই উদ্যানের সর্বত্রে অশ্লীতার ছড়াছড়ি। বিনোদন বলতে কিছুই নেই। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই পার্কগুলোতে অসংখ্য প্রেমিক-যুগলের ভীড় লেগে থাকে। ঘন্টার পর ঘন্টা যে কর্মকান্ড করে সেটা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। এদের মধ্যে অধিকাংশই স্কুল-কলেজ পড়ুয়া কিশোর-কিশোরী বা যুবক-যুবতী। পার্ক বা উদ্যানগুলোতে সতর্কবাণী থাকলেও কার্যত এই নির্দেশনা লোক দেখানো। লেখা দেখেও কেউ তা মানছেন না ।

চন্দ্রিমা উদ্যানে কনডমের ছড়াছড়ি !

এখানে এসেই দেখা গেল অস্বস্তিকর পরিস্থিতি, আপনি হইতো তা জানার জন্য মোটেও প্রস্তুত নন! ক্লান্ত দেহে স্বস্তির নেয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট জিয়ার মাজারের ভেতর দিয়ে পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে ১০০ গজ দূরে আসতেই আমরা বসে পড়লাম দর্শকদের জন্য দেয়া সারিবদ্ধ আসনে৷

বসেই পানি পান করছি ৷ হঠাৎ চমকে উঠি ! পায়ে নিচে কনডম ৷ একটি ৷ না ! ৫ থেকে ৬ টি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে ৷ পরবর্তী আসনগুলোতে ও কনডমের খোঁজ মিলল ! হিসাব নিকাশ পাল্টে গেল ! সভ্য সমাজে অসভ্যতার এ অভয়াশ্রম, স্বীয় বিবেক বোধকে বিকারগ্রস্ত করল! ভাবছি, ছি ! ছি ! ছি !

স্কুল পড়ুয়াদের উদ্যানের ভেতরে ঘুরাঘুরি

অপরদিকে দেখা যায়, স্কুলপড়ুয়া ছেলে-মেয়েরা স্কুল ফাঁকি দিয়ে ইউনিফর্ম পরে পার্কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিচ্ছে। ঘুরছে দেদারসে ! যদিও  ছাত্র-ছাত্রীদের  ইউনিফর্ম পরে উদ্যানে প্রবেশ সম্পূর্ন নিষিদ্ধ এমন ঘোষনা দেয়া আছে । কিন্তু কে রুখে তাদের !

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়েও দেখা গেছে একই চিত্র । একটি সূত্র জানায়, রাতের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হয়ে ওঠে মাদক ব্যবসায়ী-মাদকসেবী ও পতিতাদের আস্তানা। উদ্যানের ভেতরে গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইনসহ বিভিন্ন প্রকার মাদকদ্রব্য বিক্রি হয়।

ঝুলছে নির্দেশনা , মানছে কি কেউ ?

এখানে যারা মাদক বিক্রি করে তারা অনেকটা সন্ত্রাসী প্রকৃতির। এদের মাদকদ্রব্যের গ্রাহক হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। পুলিশ থাকা সত্ত্বেও এখানে রাতের বেলায় অসামাজিক কর্মকাণ্ড- চলে আসছে অনেকটাই নির্বিঘ্নে ৷

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পুলিশ সদস্য ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, ‘আমরা কি করব ? তাদের আটক করে জেলে পাঠালে পরের দিনই আবার এখানেই দেখতে পাই।‘

তিনি আরও জানান, উদ্যানে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এক শ্রেণীর প্রেমিক-প্রেমিকার নির্লজ্জ উচ্ছৃংখলতা দেখে লজ্জিত না হয়ে উপায় নেই!

ঢাকার আরেকটি ঐতিহ্যবাহী স্থান হচ্ছে ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবর এলাকা। সেই জায়গায় সময় পেলেই সকল বয়সের মানুষেরা চায়ের আড্ডা জমায় কিন্তু সেই জায়গাও জোড়া জোড়া বসা ও একজনের কাঁধে আরেক জনের মাথা রাখা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। ধানমন্ডির ৮- এ ডিঙ্গি নৌকা ভাঁড়া দেওয়া হয়। কিন্তু সেই ডিঙ্গিরও মধ্যেই সন্ধ্যার পরে অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয়ে থাকে ডিঙ্গিতে চড়া শিক্ষার্থীরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুজীব বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র শিহাব উদ্দীন জানান, ‘আমরা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্র হয়েও এই উদ্যানেগুলোতে আসি না এরকম বাজে পরিবেশের কারনে ৷’

উদ্যানগুলোতে ঘুরতে যাওয়া এক কলেজ শিক্ষক বলেন, ‘সুস্থ কোন মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে উদ্যানগুলোতে ঘোরাফেরা করার কোন অবকাশ নেই। প্রকাশ্যে জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়া, ঘন্টার পর ঘন্টা বুকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকা, ছাতা মেলে সেটার আড়ালে আরো কত সূড়সূড়ি। চোঁখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।’

প্রতিদিন বিকাল হলেই ছেলেমেয়েদের নিয়ে ঘুরতে আসেন তাসলিমা আক্তার। তার বাসা ফার্মগেটে। তিনি উদ্যানের ভিতরের শিক্ষার্থীদের অশ্লীল আচরণ দেখে তাড়াহুড়া করে বের হয়ে যান। তিনি বলেন, ‘সেখানে কোন ভদ্র মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে যায় না।’ আর প্রতিদিন স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়ে তরুণী, গৃহবধূরা কাজের বাহানা দিয়ে ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে আসে। এসব তো আগে ছিল না। দিন দিন এর সংখ্যা বাড়ছে।’

তিনি আরো বলেন, এখানে আসা শিক্ষার্থীদের দিনভর চলে তাদের উশৃঙ্খলতা। কোন নিষেধাজ্ঞা নেই অশ্লীল কাজে। প্রতিদিন যখন এখানে এই অসামাজিক কার্যকলাপ চলছে অবাধে, সেখানে সচেতন মানুষেরও যেন কোন দায়বদ্ধতা নেই। এই অশ্লীল কার্যকলাপ বন্ধ না করলে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত অন্ধকার পথে চলে যাবে।

এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামিনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর বাংলাদেশ টিম মেম্বার জাওয়াদুল করীম এ প্রতিবেদককে বলেন, প্রশাসনের কঠোরতা না থাকায় নগরীর পার্কগুলো যেনো মাদকব্যবসায়ী-মাদকাসক্ত ও পতিতাদের দখলে চলে যাচ্ছে।

তার প্রশ্ন হলো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি থাকলে প্রকাশ্যে পার্কগুলোর এমন অবস্থা হয় কী করে?

তিনি জানান, নগরের পার্কগুলোকে অপরাধীরা তাদের অপকর্মের স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছে। দর্শনার্থীরা হারাচ্ছে বিনোদন কেন্দ্র। এসব পার্ককে অপরাধীদের হাত থেকে মুক্ত করতে ধর্মীয় অনুশাসন, আইনের সঠিক প্রয়োগ, প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদেরও বিশেষ ভূমিকা নিতে হবে।

#একুশ নিউজ/এএইচ

Comments