পিতামাতার ঝগড়া কী প্রভাব ফেলে শিশুর উপর ?

প্রকাশিত: ১১:০২ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ২, ২০১৮

স্বাস্থ টিপস্ : বাবা মায়ের মধ্যে ঝগড়া-ঝাঁটি হওয়া খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়। অল্প বয়স থেকেই শিশুর উপর তার পিতামাতার সংঘাতের প্রভাব পড়তে পারে এই কথাটা উভয়ের খেয়াল রাখা খুবই জরুরি।

এর ফলে শিশুর যে ক্ষতি হয় তার হাত থেকে সন্তানকে বাঁচাতে পিতামাতারা কী করতে পারেন! তার কিছু টিপস নিম্নে তুলে ধরা হলো,

‘বাড়িতে কী ঘটছে’ এবিষয়টা আসলেই দীর্ঘ মেয়াদে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে বড় রকমের ভূমিকা রাখে। পিতামাতার সাথে সন্তানের সম্পর্ক কেমন এটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি গুরুত্বপূর্ণ তাদের দু’জনের মধ্যে সম্পর্কটা কেমন সেটাও। তাদের একজন আরেকজনের সাথে কী ধরনের আচরণ করছেন সেটা শিশুর বেড়ে ওঠার উপর বড় রকমের প্রভাব ফেলে। বলতে গেলে শিশুর সবকিছুই এতে প্রভাবিত হয়। যেমন তার মানসিক স্বাস্থ্য কি রকম হবে, পড়ালেখায় সে কেমন করবে, এমনকি ভবিষ্যতে এই শিশু যেসব সম্পর্কে জড়াবে সেগুলো কেমন হতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি।

পিতামাতার মধ্যে এই ঝগড়া-বিবাদ নানা রকমের হয়ে থাকে। কোন কোন বিতর্কের হয়তো প্রভাবই পড়ে না, এমনকি শিশুর ভবিষ্যতের জন্যে সেটা হয়তো ভালোও হতে পারে, কিন্তু পিতা মাতা যখন একে অপরের প্রতি ক্রুদ্ধ আচরণ করেন, করেন চিৎকার চেঁচামেচি, অথবা তারা একে অপরের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেন, তখনই হয়তো কিছু একটা সমস্যা দেখা দিতে পারে।

এবিষয়ে বাড়িতে পিতামাতার আচরণ পর্যবেক্ষণ করে ব্রিটেনে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গত কয়েক দশকে যেসব গবেষণা হয়েছে তাতে দেখা গেছে, তাদের ঝগড়াঝাঁটির প্রভাব পড়তে পারে ছ’মাস বয়সী শিশুর উপরেও।

শিশু মানসকি বিকারগ্রস্ত হতে পারে

বাড়িতে যখন তারা বাবা মায়ের মধ্যে কোন ধরনের সহিংস সম্পর্ক দেখে তখন তাদের হৃদকম্পন বেড়ে যেতে পারে কিম্বা মানসিক চাপের কারণে হরমোন-জনিত সমস্যারও সৃষ্টি হতে পারে। এর ফলে বাচ্চা, শিশু এবং অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের মস্তিষ্ক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে, ভুগতে পারে ঘুমের সমস্যায়, উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তায়, বিষণ্ণতা এবং এধরনের পরিবেশের মধ্যে খুব বেশিদিন থাকলে তাদের আচরণগত গুরুতর সমস্যাও দেখা দিতে পারে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে শিশুর লেখাপড়াও, এমনকি কখনও কখনও শিশুদের উপর এই প্রভাব যেরকম হতে পারে বলে ধারণা করা হয় তার চেয়ে অন্যরকমও হতে পারে।

যেমন ডিভোর্স বা বিবাহবিচ্ছেদ কিম্বা পিতামাতা হয়তো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে তারা আলাদা থাকবেন- এর ফলে হয়তো অনেক শিশুর উপরেই তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে সবসময় যে ঠিক এরকম হবে তা কিন্তু নয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংসার ভেঙে যাওয়ার কারণে শিশু যতোটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার চেয়েও বেশি সমস্যা হয় বাবা মায়ের সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার সময় বা তার আগে ও পরে দু’জনের মধ্যে যেসব ঝগড়াঝাঁটি হয় সেসবের কারণে।

একইভাবে, এরকম পরিস্থিতিতে শিশু কিভাবে বেড়ে উঠবে বা সাড়া দেবে সেটা তার জিনগত গঠন বা জেনেটিক্সের উপরেও নির্ভর করে। তবে এটা ঠিক যে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের উপর পিতামাতার আচরণ বড় রকমের প্রভাব ফেলে এবং সেখান থেকে তার ভেতরে দুশ্চিন্তা, বিষণ্ণতা ও মানসিক সমস্যারও সৃষ্টি হতে পারে।

সেকারণে বাড়ির পরিবেশ এবং সেই পরিবেশে শিশুরা কীভাবে বেড়ে উঠছে সেটাও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। শিশুর মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে এই বড় রকমের ভূমিকা রাখে।

তবে এর কেন্দ্রে রয়েছে- বাবা মায়ের মধ্যে সম্পর্ক। এই সম্পর্ক কতোটা ভালো কিম্বা কতোটা খারাপ এসবের উপরেই নির্ভর করছে শিশুর বেড়ে উঠা।

অল্প বয়স থেকেই শিশুর উপর তার পিতামাতার সংঘাতের প্রভাব পড়তে পারে

শিশুকে নিয়ে ঝগড়া

কিন্তু পিতামাতার মধ্যে এই ঝগড়াঝাঁটি হয় এই শিশুকে কেন্দ্র করে তখন কি হবে?

প্রথমত এটা মেনে নিতে হবে যে কোন বিষয়ে পিতামাতার একমত হওয়া কিম্বা ভিন্নমত পোষণ করা কিম্বা ঝগড়া করা স্বাভাবিক একটি ঘটনা। একসাথে এক বাড়িতে বসবাস করতে গেলে এরকম কিছু মনোমালিন্য হবেই।

কিন্তু এটা নিয়ে পিতামাতা যখন সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন, এবং সেটা যদি খুব বেশি ঘন ঘন হয়, এর মাত্রাও হয় তীব্র, এবং সেটা সমাধানের দিকে না গড়ায় তাহলে শিশুর উপরে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আর সেটা যদি শিশুটিকে নিয়ে হয় তাহলে সেই প্রভাব হবে আরো বেশি। কারণ এই ঝগড়াঝাঁটির জন্যে শিশুটি তখন নিজেকে দায়ী করতে থাকে। শিশুটি তখন মনে করে যে সে-ই হলো এই সমস্যার কারণ ও কেন্দ্র। তার কারণেই এতো মারামারি।

নেতিবাচক এসব প্রভাবের ফলে শিশুর নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে, বাচ্চাদের মস্তিষ্কের প্রাথমিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, উদ্বেগ দুশ্চিন্তা তৈরি হতে পারে, স্কুলে তার আচার আচরণে সমস্যা হতে পারে। বিষণ্ণতায় ভুগতে পারে। খারাপ করতে পারে লেখাপড়ায়।

গবেষণা বলছে, এরচেয়েও খারাপ কিছু হতে পারে- যেমন নিজেই নিজের ক্ষতি করা। তবে এটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয় একটু বড় হয়ে উঠা ছেলেমেয়েদের বেলায়।

শিশুরা সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রেও সমস্যায় ভুগতে পারে। সংঘাতময় পরিবারের কারণে সে নিজেকে আলাদা করে রাখে
বহু বছর ধরেই আমরা জানি যে পরিবারের ভেতরে নির্যাতন কিম্বা সহিংসতা শিশুর জন্যে ক্ষতিকর। আর সেই ক্ষতি যে শুধু পিতামাতার প্রকাশ্য ঝগড়াঝাঁটি ও সংঘর্ষের কারণেই তা কিন্তু নয়। পিতামাতা যদি একে অপরের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেয়, একজন আরেকজনকে উপেক্ষা অবহেলা করতে থাকে তখনও কিন্তু শিশুদের উপর বড় রকমের প্রভাব পড়ে। শিশুর মানসিক, আবেগ অনুভূতি, আচরণ এবং সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রেও তখন সমস্যা হতে পারে।

এখানেই কিন্তু সমস্যার শেষ নয়। এর ফলে শিশুরা শুধু তাদের নিজেদের জীবনেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, এর প্রভাব পড়ে প্রজন্মের পর প্রজন্মের উপরেও।

গবেষকরা বলছেন, এটা একটা চক্রের মতো। কারণ আজকে যারা শিশু, আগামীতে তারাই কিন্তু শিশুর পিতামাতা। আমরা যদি সুখী জীবন চাই তাহলে কোন একটা সময় এই চক্রটা ভেঙে দিতে হবে।

শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের উপরেও পড়তে পারে নেতিবাচক প্রভাব

আড়ালে ঝগড়া
তবে শিশুর উপর নেতিবাচক প্রভাব কমানোর কিছু উপায় আছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুর দুই বছর বয়স থেকে, কিম্বা তার আগে থেকে শিশুরা বাড়িতে তাদের পিতামাতার আচরণের উপর নজর রাখতে শুরু করে। অনেক সময় পিতামাতা মনে করেন যে শিশুরা হয়তো সেটা বুঝতে পারছে না। তারা মনে করেন, আড়ালে ঝগড়া হলে শিশুরা হয়তো সেটা বুঝতে পারে না।

কিন্তু যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো শিশুরা এই ঝগড়াঝাঁটিকে কিভাবে দেখছে, কিভাবে নিচ্ছে এবং এর কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে কতোটুকু বুঝতে পারছে। পিতামাতা তাদের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে তারা বুঝতে চেষ্টা করবে; এই ঝগড়া কতদূর পর্যন্ত গড়াতে পারে। তারাও কি এর মধ্যে জড়িয়ে পড়বে কিনা, এমনকি এর ফলে পরিবারের স্থিতিও নষ্ট হয়ে যেতে পারে কিনা।

শিশুরা সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রেও সমস্যায় ভুগতে পারে। সংঘাতময় পরিবারের কারণে সে নিজেকে আলাদা করে রাখে

ছেলে ও মেয়েদের উপর পড়তে পারে ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব

গবেষণায় দেখা গেছে এরকম পরিস্থিতিতে ছেলে-শিশু ও মেয়ে-শিশুরা ভিন্ন ভিন্ন আচরণ করতে পারে। মেয়েদের বেলায় মানসিক স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বেশি হতে পারে আর ছেলেদের বেলাতে হতে পারে আচরণগত সমস্যা।

তখন এই শিশুদেরকে নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতা দিতে হবে। সেই সাহায্য আসতে পারে পরিবারের কোন সদস্য, আত্মীয় স্বজন, ভাই বোন, বন্ধু বান্ধব এমনকি স্কুলের শিক্ষকদের কাছ থেকেও।

পিতামাতার জন্যে কিছু টিপস

পিতামাতাকে বলা হয় সন্তানের প্রথম শিক্ষক। কারণ পিতামাতার কাছ থেকেই সন্তন সমস্ত অাচার ব্যবহার শিখে থাকে। তেমনই কার সাথে কি ভাবে চলতে হবে, কি ভাবে কথা বলতে হবে সমস্তকিছুর শিক্ষক পিতামাতা। তাই সামাজিক মুল্যবোধ সৃষ্টিতে পিতামাতার ভূমিকা অন্যতম।

শিশুর উপর ঝগড়াঝাঁটির প্রভাব সম্পর্কে পিতামাতারা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতে পারেন।

তবে মনে রাখবেন কখনো কখনো ঝগড়া করা খুব স্বাভাবিক। অনেক সময় পিতামাতা যখন কোন একটা বিষয় নিয়ে বিতর্ক করেন এবং সমস্যার সমাধান করে ফেলেন, তাতে শিশুরা কিছু মনে করে না, এমনকি সেটা শিশুদের জন্যে একটা ভালো শিক্ষা হিসেবেও কাজ করতে পারে। ঘরের বাইরে শিশুদের কোন সমস্যা হলে সেটা সমাধান করতে গিয়ে এই শিক্ষা তারা সেখানে হয়তো কাজেও লাগাতে পারে।

শিশু কি বলতে বা কি বোঝাতে চাইছে তা যথেষ্ট সময় ও ধৈর্য নিয়ে বুঝতে চেষ্টা করুন। তার ব্যাপারটি বুঝতে পারছেন না বলে অযথা রাগ করবেন না বা ধৈর্য হারাবেন না। এতে শিশুর মানসিক সমস্যা তৈরি হতে পারে।

/এসআর

Comments