একটি নির্দেশনা; কওমি স্বকীয়তা বিলীনের আর্তচিৎকার ও একটি সরল পর্যালোচনা

প্রকাশিত: ৭:৩৬ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ৭, ২০১৮

শাহনূরশাহীন

পটিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার স্বাক্ষরে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন শিরোনামে একটি বিজ্ঞপ্তি পত্র গতকাল থেকে ফেসবুকে ঘুরছে। বিজ্ঞপ্তিতে কওমি মাদরাসা সমূহকে কিছু নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যেই নির্দেশনার ব্যাপারে অনেকেই আপত্তি তুলে কওমি স্বকীয়তা নষ্টের অভিযোগ করছেন।

বাস্তবেই ওই নির্দেশনায় কওমি স্বকীয়তা বিরোধী কিছু রয়েছে কিনা সেই বিষয়টা নিয়ে আমরা একটু পর্যালোচনা করবো। প্রথমেই দেখে নেই নির্দেশনায় কী আছে।

নির্দেশনায় বলা হয়েছে;-
১. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন জাতীয় পতাকা উত্তোলনের ব্যবস্থা করা
২. জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা
৩. শিক্ষার্থীদের এসেম্বলির ব্যবস্থা গ্রহণ করা
৪. শ্রেণীকক্ষে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ানোর ব্যবস্থা করা।

এই চারটি নির্দেশনার পরিপত্র দেখে ফেসবুকে প্রায় অধিকাংশ কওমি প্রেমিরা কওমি স্বীকৃতির স্বকীয়তা গেলো গেলো বলে চিৎকার শুরু করেছে। আসলে কী তাই?

স্বকীয়তা বজায় রেখে কওমি স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। আচ্ছা বলুন তো স্বকীয়তার মানে কী রাষ্ট্রীয় আইন অমান্য করবেন? স্বীকৃতির দাবিতে কি বলা হয়েছে আমরা কওমিয়ানরা রাষ্ট্রীয় আইন মানবো না? এখানে প্রথম দুটো পয়েন্টে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব জড়িয়ে রয়েছে।

তৃতীয় পয়েন্টটি একটি নৈতিক নির্দেশনা যা ভিন্নভাবে আমরা পালন করে থাকি। চতুর্থ নির্দেশনাটি রাষ্ট্রের অস্তিত্বের ইতিহাস। রাষ্ট্রের জন্মের ইতিহাস। আমরা একটা একটা করে দেখবো এখানে কওমি স্বকীয়তা বিরোধী কিছু আদৌ রয়েছে কিনা।

১. জাতীয় পতাকা একটি দেশের পরিচয় বহন করে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জাতীয় পতাকা দেখে আমরা একটি দেশের পরিচিয় জানতে পারি। দেশের বাইরে গেলে একটি পতাকাই সেদেশে আমাদের পরিচয় তুলে ধরার জন্য যথেষ্ট। রাষ্ট্রে বসবাস করে রাষ্ট্রের সেই পতাকা উত্তোলনে আপত্তি কিসের? এখানে তো কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়।

কওমি মাদরাসা সংশ্লিষ্টরা তো এদেশেরই নাগরিক। দেশের নাগরিক হয়ে দেশের পতাকার প্রতি সম্মান দেখাবে না, পতাকার অস্তিত্ব স্বীকার করবে না এটা তো হতে পারে না। যেই পতাকার অস্তিত্ব আমি স্বীকার করবো না সেই পতাকাবাহী রাষ্ট্রও তো আমাকে স্বীকার করবে না। আমাকে স্বীকৃতি দিবে না। কোনো যৌক্তিকতা নেই দেওয়ার।

একটি পতাকার কত মূল্য, এর মর্ম কী তা হাড়ে হাড়ে টের পাবেন পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি কিংবা বান্দরবান গেলে। এই তিন পার্বত্য জেলার গহীণ অরণ্যে, পাহাড়ের চূড়ায় বাঙালি বিহীন এলাকায় গিয়ে যখন একখন্ড পতাকা দেখতে পাবেন তখন চিৎকার করে বাংলাদেশ বাংলাদেশ বলতে ইচ্ছে করবে।

একটি পতাকা দেখতে পেলে মনে হবে আপনি বাংলাদেশেই আছেন। নতুবা মনে হতে পারে আপনি ভিনদেশে ঢুকে পড়েছেন। নিজেকে তখন অসহায় মনে হবে। এখন যেমন প্রশাসনিক এলকায় ঢুকলে দাড়ি টুপিওয়ালারা নিজেদের অসহায় ভাবে ঠিক তেমন।

২. বাংলাদেশের সংবিধানের ৪ নং অনুচ্ছেদের ১ নং উপধারায় বলা হয়েছে ‘আমার সোনার বাংলা’র প্রথম দশ চরণ দেশের জাতীয় সঙ্গীত বলে বিবেচিত হবে। জাতীয় সঙ্গীত একটি দেশের জাতীর অস্তিত্বের কথাগুলোই বলে থাকে। বলে থাকে দেশের প্রতি দেশের মানুষের ভালোবাসার কথা। সেই জাতীয় সঙ্গীতেও তো আপত্তি থাকার কথা নয়। শুধুমাত্র হিন্দু লেখক হওয়াতেই যদি আপনার আপত্তি হয় তবে আপনাকে পৃথিবীর বাইরের কোনো দেশে চলে যেতে হবে।

হিন্দু লেখকের লেখা পড়া কোথায় নিষেধ করা হয়েছে? তাদের তৈরি খাবার কি আপনি খান না? হিন্দুদের তৈরি দ্রব্য আপনি ব্যবহার করেন না? আপনি এটা নিয়ে যত কথাই বলেন, রাষ্ট্র স্বীকৃত জাতীয় সঙ্গীত অস্বীকার করার মানে রাষ্ট্রকে অস্বীকার করা।

সুতরা রাষ্ট্রে বসবাস করতে হলে জাতীয় সঙ্গীত মেনে নিতে হবে। এটা আপনি কওমি স্বীকৃতি নিলেও মানতে হবে স্বীকৃতি না নিলেও মানতে হবে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের সকল নাগরিককেই এটা মানতে হবে। হ্যাঁ, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাসের পরিপন্থি কিছু থাকলে তা রাষ্ট্রের কাছে উপস্থান করা যেতে পারে।

৩. এসেম্বলি। কী এটা? শিক্ষার্থীদের শপথ করানো। আমি আমার দেশের সম্মান বৃদ্ধি করবো, নিজেকে দেশের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবো, রাষ্ট্রের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবো। এগুলো সমস্বরে উচ্চারণ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে।

এটা তো সব প্রতিষ্ঠানেই করে। সব আদর্শ শিক্ষকরাই শিক্ষার্থীদের এই শিক্ষা দেয়। হয়তো নিজস্ব কৌশলে। হ্যাঁ কওমি মাদরাসায়ও এই শিক্ষা দেয়া হয়। সেটা হয়তো নির্দেশনায় আনুষ্ঠানিকতার কথা বলা হয়েছে। তাতে কিসের আপত্তি? এখানে স্বকীয়তা বিলীন হলো কোথায়?

আলোচনা সাপেক্ষে কর্তৃপক্ষ চাইলে এখানে আনুষ্ঠনিকতার নিয়মে প্রয়োজনে পরিবর্তন আনতে পারে। কওমি আইনে কর্তৃপক্ষকে সেই অধিকার দেয়া হয়েছে।

৪. মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়া। কিভাবে আপনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়তে অস্বীকার করবেন? যে মুক্তিযুদ্ধের কারণে বাঙালি বিশ্বের বুকে গর্বিত জাতি হিসেবে নিজেদের গৌরব প্রকাশ করতে পারে আপনি সেই যুদ্ধের ইতিহাস পড়বেন না তাহলে আপনার চেয়ে গাদ্দার নাগরিক আর হতে পারে না।

আমি তো মনে করে মুক্তিযুদ্ধর ইতিহাস বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধে ওলামায়ে কেরামের অবদানের ইতিহাস পড়ানো ওয়াজিব। আমাদের প্রিয় ভাই শাকের হোসাইন শিবলীর ‘আলেম মুক্তিযুদ্ধার খোঁজে’ বইটি প্রত্যেক মাদরাসায় বাধ্যতামূলক করা উচিত। এবং সেই সাথে কওমি সিলেবাসের জন্য ওলামায়ে কেরামকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনায় হাত দেওয়া উচিত।

আজকে যদি বলা হতো, প্রধানমন্ত্রীর ছবি ঝুলাতে তখন আপনি আপত্তি করতে পারতেন। কারণ, স্বীকৃতির আইনে বলা হয়েছে কওমি মাদরাসা তথা ওলামায়ে কেরামের ঈমান আকিদা বিরোধী কোনো নির্দেশনা দেওয়া যাবে না। কোনো প্রাণী তথা মানুষের ছবি প্রদর্শন ওলামাদের ঈমান আকিদা বিরোধী বিধায় সেটার আপত্তি করতে পারেন আপনি।

তারপর আসতে পারেন, এই নির্দেশনা দেয়ার অধিকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার আছে কিনা সেটা পর্যালোনা করা যেতে পারে। কারণ আইন অনুযায়ী শিক্ষামন্ত্রণালয়ও কোনো নির্দেশনা বা পরিপত্র জারি করতে পারবে না কওমি মাদরাসায়। যাবত্রীয় পরিপত্র, নির্দেশনা জারি করবে স্বীকৃতি কমিটি তথা র্বোড আলহাইয়াতুল উলইয়া। কোনো বিষয়ে প্রয়োজন হলে বোর্ড কর্তপক্ষ শুধুমাত্র শিক্ষামন্ত্রণালয়কে অবহিত করে রাখবে।

এমনকি মাদরাসাগুলোর ওপর প্রধানমন্ত্রী বা শিক্ষামন্ত্রণালয় থেকে এই নির্দেশনা আসার কথা নয়। প্রধানমন্ত্রীর কোনো নির্দেশনা বা পরামর্শ থাকলে সেটা তো বোর্ডে আসবে বোর্ড কর্তৃপক্ষ সেটা বাস্তবায়ন করবে।

আর সেক্ষেত্রে বোর্ডকে দেয়া হয়েছে পূর্ণ স্বাধীনতা। সমালোচনা বা আর্তচিৎকার না করে বোর্ড কর্তৃপক্ষের উচিত হবে আলোচনা সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

সনদ আইনের খসড়া অনুমোদনের পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেছেন, আইনের উদ্দেশ্য পূরণে বিধি ও সংবিধি প্রণয়নের সুযোগ রাখা হয়েছে। অন্যান্য আইনে যাই থাকুক না কেন এই আইনের বিধানাবলি প্রাধান্য পাবে। (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৪.০৮.১৮ইং)

অর্থাৎ শিক্ষা আইনের কোনো ধারা যদি কওমি স্বকীয়তার পরিপন্থি হয় সেক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ সেটা এড়াতে পারবে। প্রয়োজেনে নতুন বিধি প্রণয়ণ করতে পারবে এবং সেই বিধিই প্রাধান্য পাবে।

কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড হবে একটি ভিন্নধর্মী শিক্ষা বোর্ড। যেহেতু এটি ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেহেতু এর ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। তবে বোর্ড তাদের পরীক্ষাসংক্রান্ত বিষয়গুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করবে। (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৯.০৮.১৮ইং)

কওমি আইনের ৩(২) উপধারায় বলা হয়েছে, ‘কর্তৃপক্ষ একটি স্বাধীন ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হইবে।’ এ উপধারা থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, এ কর্তৃপক্ষ সরকারের অধীন আজ্ঞাবহ কোনো সংস্থা হবে না। বরং এ আইন তাকে আপন কাজে, আপন পরিধির ভেতর সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিচ্ছে।

এমনকি ওই আইনের ৫ ও ৬ নম্বর ধারা অনুযায়ী বোর্ডের চেয়রম্যানসহ অন্যান্য সদস্য নিয়োগ প্রকিয়ায় কর্তৃত্ব দেয়া হয়েছে আল হাইয়ার অধীনস্ত আঞ্চলিকে বোর্ডগুলোর ওপর। সো, এখানে সরকার নিজেদের পছন্দ মতো কাউকে নিয়োগ দিয়ে কওমি স্বার্থ বিরোধী বিধি বিধান করিয়ে নিবে এমনটা ভাবার সুযোগ নেই।

সুতরাং বোর্ডগুলো কোমর সোজা করে দাঁড়াতে শিখে নিজেদের অস্তিত্বের কথা ভুলে না যায় তাহলে কওমি স্বকীয়তা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা আপাতত নেই।

কওমি আইনে এটাও বলা হয়েছে, (কওমি বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার আগ পর্যন্ত) সনদ স্বীকৃতি নিয়ন্ত্রণকারী কমিটি তথা বোর্ড আল হাইয়াতুল উলইয়া, পাঠ্যক্রম প্রণয়ন, পরীক্ষা পদ্ধতি, পরীক্ষার সময় নির্ধারণ, অভিন্ন প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও উত্তরপত্র মূল্যায়ন, ফলাফল এবং সনদ তৈরিসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এক বা একাধিক উপ-কমিটি গঠন করতে পারবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়গুলো অবহিত করবে কমিটি। এই কমিটি দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকবে। (ঢাকা টাইমস, ১৩.০৮.১৮ ইং)

সুতরাং স্বকীয়তা রক্ষায় আইন অনুযায়ী বোর্ড থেকে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিদের বোর্ড থেকে বের করা উচিত।

কেননা রাজনৈতিক নেতারাই ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থের কারণে কওমি স্বকীয়তার স্বার্থ ভুলে যেতে পারে। যে কোনো সরকারে আনুকুল্য পাওয়ার লোভে ভুলে যেতে পারে কওমি স্বকীয়তার কথা।

সো, খালি মাঠ পেলেন আর নাচতে শুরু করলেন এই অভ্যাস পরিহার কুরন। দেশের নাগরিক হিসেবে নিজরে দায়িত্বগুলো বুঝে নিন। পালন করার চেষ্টা করুন। নতুবা সারাজীবন স্বাধীনতা, স্বাধীনতার চেতনা বিরোধী হিসেবে গালি খেতেই থাকবেন। জবাব দিতে পারবেন না।

সমালোচনা করবেন করুন। জেনে বুঝে করুন। কেউ একজন একটা বলল আপনিও বলা শুরু করলেন। এই জ্ঞান নিয়ে কারো সমালোচনা করা যায় না।

নিজের দায়িত্ব, নিজের ইতিহাস, দেশের ইতিহাস জানুন। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার আসল চেতনার কথা প্রচার করুন। রাষ্ট্রকে নিজের অস্তিত্বের জানান দিন।

লেখক: কবি, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

/আরএ

Comments