ইসলাম ও স্বাস্থ্য বিজ্ঞান; রোজার শারীরিক ও আধ্যাত্বিক উপকারিতা

প্রকাশিত: ৬:১৪ অপরাহ্ণ, মে ২০, ২০১৮

শাহ্ মুহাম্মদ আরিফুল কাদের

ইসলামের স্তম্ভ পাঁচটি। তন্মধ্যে রমজানের রোজা শারীরিক ও অধ্যাত্মিক একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। যার মাধ্যমে সহজে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। সর্বসেরা এ মাসটিতে রয়েছে মানবজাতির জন্য রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের বার্তা। যা মানবজাতির উপর ফরজ করা হয় দ্বিতীয় হিজরির শা’বান মাসে মদিনাতুল মুনাওয়ারায়। রোজা ফরজ হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রমজানের রোজা ফরজ করা হয়েছে। যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পার’। [সূরা বাকারাঃ আয়াত নং- ১৮৩]

তাই পূর্ণ রমজান মাসের রোজা রাখা প্রত্যেক বালেগ ও মুসলমান নর-নারীর অবশ্য কর্তব্য। জেনে রাখা উচিত যে, অন্যান্য সকল ইবাদতে লৌকিকতা বা মানুষকে দেখানোর জন্য হতে পারে। কিন্তু রোজা এমন এক ইবাদত যা কখনো মানুষকে দেখানোর জন্য করা যায় না। বরং সুবেহ সাদিক থেকে সূর্য অস্তমিত হওয়া পর্যন্ত এক আল্লাহর নির্দেশ পালন ও সন্তুষ্টির জন্যই উপোস থাকতে হয়। আর সেই রোজার পারিভাষিক অর্থই হলো, সুবেহ সাদিক থেকে সূর্য অস্তমিত হওয়া পূর্ব পর্যন্ত খাওয়া-দাওয়া ও যাবতীয় পানাহার, স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকার নাম।

সেই হিসাবে বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের নিমিত্তে রোজা রাখার ফলে দুনিয়া ও পরকালীন কল্যান নির্ধারণ করে রেখেছেন। পরকালীন কল্যান বা পুরস্কার সম্পর্কে হাদিসে কুদসীতে বর্ণিত আছে, ‘নিশ্চয়ই রোজা আমার জন্য এবং এর প্রতিদান আমি স্বয়ং আল্লাহই দিবো’। [হাদীসে কুদসী পৃ. নং ১৩৪]

বান্দার নেক আমলের প্রতিদানের ব্যাপারে ইমাম মুসলিম রা. বর্ণনা করেন, রমজানে বনি আদমের প্রত্যেকটি সওয়াব বৃদ্ধি করা হয়, এক নেকীর সওয়াব দশ নেকী হতে সাতশত গুণ পর্যন্ত। তবে রোজা ছাড়া (রোজাদারের সওয়াব সীমাহীন) কারণ রোজা হলো আমার জন্য, আর আমিই তার প্রতিদান দিব। [রিয়াজুচ্ছালেহীন হাদিস নং ১২১৫]

জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ সম্পর্কে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, কোন বান্দা যদি একদিন আল্লাহর ওয়াস্তে আল্লাহর রাস্তায় রোজা রাখে। আল্লাহ তা’য়ালা তাকে জাহান্নাম থেকে সত্তর খারীফ দূরে রাখবেন। [সহিহ বুখারী]

সুতরাং রমজানেতো পূর্ণ একমাস রোজা রাখতে হয়। সে হিসাব অনুযায়ী উম্মতে মুহাম্মাদির স্থান জাহান্নাম থেকে কত দূরে হবে তার হিসাব করা খুবই কঠিন।

তাই জান্নাতের সুসংবাদ দিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, কিয়ামতের দিন রাইয়ান দরজা দিয়ে রোজাদানগণ প্রবেশ করবেন। তাছাড়া এ দরজা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। ডাকা হবে রোজাদারগণ কোথায়? তখন রোজাদারগণ দাড়াবেন এবং জান্নাতে প্রবেশ করলে সে রাইয়ান দরজা বন্ধ করে দেবে। [সহিহ বুখারি]

গোনাহ মাফের সুসংবাদ দিয়ে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি উত্তমরুপে সিয়াম ও কিয়াম (তারাবিসহ অন্যান্য আমল) পালন করে- তার প্রথম পুরস্কার এই যে, সে রমজান শেষে গোনাহ থেকে ওই দিনের মতো পবিত্র হয়, যেদিন মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল। [সহিহ মুসলিম]

এ প্রসঙ্গে রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো ইরশাদ করেন- ‘যে ঈমান ও বিশ্বাস সহকারে সওয়াবের আশায় শবে কদরের নামাজ পড়বে এবং রমজানের রোজা রাখবে তার অতীতের সব গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে’। [সহিহ বুখারী হাদীস নং ১৭৮০]

রমজান মাসে মৃত মুসলিমদের সাধারণ ক্ষমার ঘোষণায় হজরত আবু সাঈদ খুদরী রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, আল্লাহতাআলা রমজান মাসের প্রত্যেক দিবস ও রাত্রিতে অসংখ্য মৃত মুসলিম ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন। এবং প্রত্যেক মুমিন বান্দার একটি করে দুআ কবুল করেন। (-মুসনাদে আহমদ, হাদিস ৭৪৫০)

রোজাদারদের দোয়া কবুল সম্পর্কে হাদিস শরীফে রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তিন ধরনের লোকের দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। ১. রোজাদারের দোয়া; ইফতারের সময় যে দোয়া করে থাকে। ২. ন্যায়পরায়ণ শাসকের দোয়া। ৩. মজলুমের দোয়া। [সহিহ তিরমিযি, আহমাদ, সহিহ ইবনে খুজাইমা, ইবনে হিব্বান]

পরকালীন উম্মতে মুহাম্মাদির রোজাদারদের আরো পাঁচটি পুরস্কার সম্পর্কে হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, রমজান উপলক্ষ্যে উম্মতে মুহাম্মদিকে পাঁচটি পুরস্কার দান করা হয়েছে যা পূর্ববর্তী উম্মতকে দেওয়া হয় নাই। (১) রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশক আম্বরের চেয়েও বেশি সুঘ্রাণযুক্ত। (২) রোজাদার বান্দার জন্য ইফতার পর্যন্ত সমুদ্রের মাছ পর্যন্ত মাগফিরাতের দোয়া করে। (৩) প্রতিদিন তাদের জন্য জান্নাতকে সুসজ্জিত করা হয়। (৪) পবিত্র মাহে রমজানে শয়তানকে শৃংখলাবদ্ধ করা হয়। (৫) রমজানের শেষ রাতে রোজাদারদের জন্য মাগফিরাত ঘোষণা করা হয়। [আহমাদ, বাযযার ও বায়হাকি]

এভাবে রোজাদার উম্মতে মুহাম্মদির অনেক অফার হাদিসে নববীতে উল্লেখ করা হয়েছে। রোজা শুধু দুনিয়া ও পরকালীন পুরস্কারে সীমাবদ্ধ নয়। বরং স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী। তাই এর উপকারিতা সম্পর্কে ‘ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অন হেলথ অ্যান্ড রামাদান’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে রোজার স্বাস্থ্যকর দিক নিয়ে অন্তত ৫০টি নিবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। যাতে মহান প্রভু কর্তৃক পুরস্কারের পাশাপাশি দৈহিক উপকারও উল্লেখ করা হয়েছে। [দৈনিক ইত্তেফাক ৩রা জুন ২০১৭]

ইসলামিক বিশেষজ্ঞগণও রোজার উপকারিতা অধিক বলে উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে প্রধান চারটি উপকারিতার কথা উল্লেখ না করলেই নয়। আর তা হলো-
১. দূষিত পদার্থ বের করে দেয়: ফাস্টফুড, সাদা রুটি, পিৎসা জাতীয় তৈরী খাবার শরীরে ঢুকে ‘টক্সিনে’ রুপান্তরিত হয়। তা থেকে উপকার পেতে প্রয়োজন নির্দ্দিষ্ট সময় উপোস থাকা। রোজা রাখার ফলে এসব দূষিত ও ক্ষতিকর পদার্থগুলো বের হয়ে যায়। ফলে গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা কম হয়।
২. ডায়বেটিস প্রতিরোধে সহায়ক: মাহে রমজানে সরাদিন না খেয়ে থাকায় শরীরের অতিরিক্ত ‘গ্লুকোজ’ বা শর্করা জাতীয় খাবারের দ্রুত ক্ষয় হয় এবং দেহের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি যোগায়। যার ফলে শরীরে ‘গ্লাইকোজেন’ তৈরী হয় ও ‘ব্লাডসুগার’ কমে ডায়বেটিস প্রতিরোধে সহায়ক হয়।
৩. উচ্চরক্তচাপ হ্রাস পায়: না খেয়ে থাকায় শরীরে অতিরিক্ত গ্লুকোজ ও চর্বিকণাগুলোর ক্ষয় হয়ে শক্তি উৎপাদন হয় এবং মেটাবলিক রেট কমে। তাছাড়া অন্যান্য হরমোনের মতো ‘স্ট্রেস হরমোন’ কমে। ফলে উচ্চরক্তচাপ কমতে পারে। এমনকি সারাদিন রোজা রাখার ফলে শরীরে অধিক ‘কোলেস্টোরলের’ মাত্রা কমিয়ে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়।
৪. অতিরিক্ত ওজন কমে: সংযমের মাসে সারাদিন না খাওয়াতে পাকস্থলী কিছুটা ছোট হয়। ফলে ওজন কমানো সহজ হয়। এছাড়াও রোজা রাখার ফলে ধুমপান কম করাতে একেবারেই তা ছাড়ার মতো হয়ে যায়। যার কারণে বিভিন্ন মরণ ব্যাধি থেকে হেফাজত থাকা যায়।

লেখকঃ- নির্বাহী পরিচালক, পানাহার স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা
(প্রাইভেট), করিমগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ।

/এমএম

Comments