ইতিহাস-ঐতিহ্যে পহেলা বৈশাখ ! শুভ নববর্ষ

প্রকাশিত: ৭:৪৬ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ১৪, ২০১৮

শেখ রাশেদ : সন একটি আরবী শব্দ। পবিত্র কুরআন মজিদে সূরা আনকাবুত এ সানা বা বছর সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে এই সানা শব্দের পরিবর্তিত রূপই সন। আর সাল শব্দটি উর্দু ও ফার্সী ভাষায় ব্যবহৃত হয়। বাংলায় সনকে অব্দ বা সাল নামে অভিহিত করা হয়। বাংলা একাডেমী কর্তৃক বাংলা সন সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয় ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ সালে। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ’র নেতৃত্বে এ কমিটি বিভিন্ন বাংলা মাস ও ঋতুতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থ-সাংস্কৃতিক জীবনে কিছু সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতাকে নির্ণয় করে সেগুলো হতে উত্তরণের প্রস্তাবনা প্রদান করেন। বাংলা সনের ব্যাপ্তি গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির মতোই ৩৬৫ দিনের। যদিও সেখানে পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিণের পরিপূর্ণ সময়কেই যথাযথভাবে নেয়া হয়েছে। এ প্রদক্ষিণের মোট সময় ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট এবং ৪৭ সেকেন্ড। এই ব্যবধান ঘোচাতে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে প্রতি চার বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি অতিরিক্ত দিন যোগ করা হয়। ব্যতিক্রম হচ্ছে সে শতাব্দীতে, যে শতাব্দীকে ৪০০ দিয়ে ভাগ করা যায় না বা বিভাজ্য নয়। জ্যোতির্বিজ্ঞান নির্ভর হলেও বাংলা সনে এই অতিরিক্ত দিনকে আত্মীকরণ করা হয়নি। বাংলা মাস অন্যান্য সনের মাসের মতোই বিভিন্ন পরিসরের হয়ে থাকে। এই সমস্যাগুলোকে দূর করার জন্য ড. মুহাম্মদ শহীদূল্লাহ কমিটি বাংলা একাডেমীর কাছে কতকগুলো প্রস্তাব পেশ করে। এগুলো হচ্ছে :-

  • বছরের প্রথম পাঁচ মাস অর্থাৎ বৈশাখ হতে ভাদ্র হবে ৩১ দিনের;
  • বাকী মাসগুলো অর্থাৎ আশ্বিন হতে চৈত্র হবে প্রতিটি ৩০ দিনের মাস;
  • প্রতি চতুর্থ বছরের ফাল্গুন মাসে অতিরিক্ত একটি দিন যোগ করে তা হবে ৩১ দিনের।

পহেলা বৈশাখ

পয়লা বৈশাখ বা পহেলা বৈশাখ (বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখের ১ তারিখ) বাংলা সনের প্রথম দিন, তথা বাংলা নববর্ষ। দিনটি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়। ত্রিপুরায় বসবাসরত বাঙালিরাও এই উৎসবে অংশ নিয়ে থাকে। সেহিসেবে এটি বাঙালিদের একটি সর্বজনীন লোকউৎসব হিসাবে বিবেচিত। গ্রেগরীয় বর্ষ পঞ্জি অনুসারে ১৪ এপ্রিল অথবা ১৫ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালিত হয়। আধুনিক বা প্রাচীন যেকোনো পঞ্জিকাতেই এই বিষয়ে মিল রয়েছে। বাংলাদেশের প্রতি বছর ১৪ এপ্রিল এই উৎসব পালিত হয়। বাংলা একাডেমী কর্তৃক নির্ধারিত আধুনিক পঞ্জিকা অনুসারে এই দিন নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এছাড়াও দিনটি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ছুটির দিন হিসেবে গৃহীত। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা দিনটি নতুন ভাবে ব্যবসা শুরু করার উপলক্ষ হিসেবে বরণ করে নেয়। এদিন আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে। কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক হলো নববর্ষ। অতীতের ভুল ত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদ্যাপিত হয় নববর্ষ।

হিন্দু সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বার মাস অনেক কাল আগে থেকেই পালিত হতো। এই সৌর পঞ্জিকার শুরু হতো গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় হতে। হিন্দু সৌর বছরের প্রথম দিন আসাম, বঙ্গ, কেরলা, মনিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিল নাড়–এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই পালিত হত। আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর আবার পহেলা বৈশাখ উদযাপনের খবর পাওয়া যায় ১৯৩৮ সালে। তবে ১৯৬৭ সনের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি। বাংলা বর্ষপঞ্জি বা বঙ্গাব্দ বাঙালির নিজস্ব সাল হলেও, সারা বিশ্বের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ রাখতে বাংলাদেশের সব জায়গাতেই খ্রিষ্টীয় সন ব্যবহার করা হয়। ১৯৮৮ সালের ১৯ জুন থেকে আমরা বাংলা একাডেমীর সুপারিশ করা পঞ্জিকা গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালন করি।

বাংলা দিনপঞ্জীর সাথে হিজরী এবং খ্রিস্টীয় সনের মৌলিক পার্থক্য হলো হিজরী সন চাঁদের হিসাবে এবং খ্রিস্টীয় সন আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। একারণে হিজরী সনে নতুন তারিখ শুরু হয় সন্ধ্যায় আকাশে নতুন চাঁদ দৃশ্যমান হওয়ার পর আর খ্রিস্টীয় সনে নতুন দিন শুর হয় ইউটিসিক্ট ০০:০০ অনুযায়ী । ‘পহেলা বৈশাখ রাত ১২ টা থেকে শুরু নাকি সূর্যোদয় থেকে শুরু’এ নিয়ে ভিন্ন মত রয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবে সূর্যোদয় থেকে বাংলা দিন গণনার রীতি থাকলেও ১৪০২ সালের ১ বৈশাখ থেকে বাংলা একাডেমী এই নিয়ম বাতিল করে আন্তর্জাতিক রীতির সাথে সামঞ্জস্য রাখতে রাত ১২.০০ টায় দিন গণনা শুরুর নিয়ম চালু করে।

এক সময় নববর্ষ পালিত হতো আর্তব উৎসব বা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে। তখন এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল কৃষির, কারণ কৃষি কাজ ছিল ঋতু নির্ভর। ভারত বর্ষে মুঘল সমরাজ্য প্রতিষ্ঠার পরসম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদের কে খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতে হত। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘলসম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন । সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহ উল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে (৯৬৩ হিজরী সাল) বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ নভেম্বর ১৫৫৬ ইং) থেকে।

প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন য়ার প্রথম মাসের নাম ছিল ‘চৈত্র মাস’। পরে “বঙ্গাব্দ” বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয় এবং ৯৬৩ হিজরী সালের মুহাররাম মাস ছিল বাংলা বৈশাখ মাস। এজন্য বৈশাখ মাসকেই বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং ১লা বৈশাখকে নববর্ষ ধরা হয়। ইতিহাস বলে, যার হাত দিয়ে বৈশাখ কিংবা বাংলা নববর্ষের গোড়াপত্তন হয়েছে তিনি কেবল মুসলমানই ছিলেন না বরং সারা মুসলিম বিশ্বে একজন নাম করা, উদারপন্থি শাসক হিসেবে আজও পরিচিত। তিনি হচ্ছেন বহুল আলোচিত মুঘলদের অন্যতম সম্রাট ‘জালালুদ্দিন মুহাম্মদ আকবর’।

বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা হয় মূলত আকবরের সময় থেকেই। সে সময় বাংলার কৃষকরা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে বাধ্য থাকত। এরপর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হত। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে। তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা। মহাজন ও ব্যবসায়ীরা বৈশাখেই ‘হালখাত’ অনুষ্ঠান চালু করেন।হালখাতা হলো যে বছরটি চলে গেল সেই বছরের হিসাবের যোগ বিয়োগ করে পুরনো খাতাটি তুলে রেখে নতুন বছরের প্রথম দিন নতুন খাতায় হিসাব চালু করা। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সকলস্থানেই পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকানদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকে। এই প্রথাটি এখনও অনেকাংশে প্রচলিত আছে, বিশেষত স্বর্ণের দোকানে। কিন্তু এখন হালখাতার প্রচলন কমে গেছে। প্রবীণরা বলেন, লাল সালু কাপড়ের মলাটে মোড়ানো নতুন এই হিসাব খাতায় উপরে লেখা হতো ‘এলাহী ভরসা। এই এলাহী শব্দটি ও সম্রাট আকবরের‘তারিখই এলাহী’থেকে এসেছে বলে জানা যায়।

নববর্ষের উৎসব বাংলার গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফলে গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সাধারণত নববর্ষে তারা বাড়ি-ঘর পরিষ্কার রাখে, ব্যবহার্য সামগ্রী ধোয়া-মোছা করে এবং সকালে স্নানাদি সেরে পূত-পবিত্র হয়। এ দিনটিতে ভালো খাওয়া, ভালো থাকা এবং ভালো পরতে পারাকে তারা ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলজনক বলে মনে করে। নববর্ষে ঘরে ঘরে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং প্রতিবেশীদের আগমনঘটে। মিষ্টি-পিঠা-পায়েসসহ নানা রকম লোকজ খাবার তৈরির ধুম পড়ে যায়। একে অপরের সঙ্গে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় চলে। প্রিয়জনকে উপহার দেওয়ার মাধ্যমেও নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় হয়, যা শহরাঞ্চলেও এখন বহুল প্রচলিত।

ইতিহাস থেকে জানা আরও জানা যায় যে, আগে বৈশাখের অনুষ্ঠানের চেয়ে চৈত্র সংক্রান্তির অনুষ্ঠান ছিল আকর্ষণীয়। এই রেশ ধরেই বৈশাখের পদার্পণ। এখনও চৈত্রের শেষ দিনে গাঁয়ের বধূরা বাড়িঘর পরিষ্কার করে। বিশেষ করে পানিতে মাটি ছেনে ঘরের ভিতরে ও আঙ্গিনায় লেপে দেয়। উঠান ঝকঝকে পরিষ্কার করে রাখে ।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে পহেলা বৈশাখের মূল অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের গানের মাধ্যমে নতুন বছরের সূর্যকে আহবান করা। পহেলা বৈশাখ সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ছায়ানটের শিল্পীরা সম্মিলত কন্ঠে গান গেয়ে নতুন বছরকে আহবান জানান। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পাশাপাশি রাজনৈতিক আন্দোলনেও পহেলা বৈশাখ এক নতুন মাত্রা যোগ করে। বাংলা সংস্কৃতির ওপর কালো থাবা বিস্তারে পাকিস্তান সরকার পূর্বপাকিস্তানে রবীন্দ্রসংগীতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করে। তৎকালীন আইয়ুব সরকারের আমলে রবীন্দ্রসঙ্গীত তথা বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার বিরোধিতার প্রতিবাদ স্বরূপই বৈশাখের প্রথম দিনে ছায়ানট রমনার বটমূলে নববর্ষ পালনের আয়োজন করে। পরে ক্রমশই এ অনুষ্ঠান বিপুল জনসমর্থন লাভ করে এবং স্বাধীকার আন্দোলনের চেতনায় পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর নীতির বিরুদ্ধে ও বাঙালি আদর্শের লালনে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় বাংলা নববর্ষ পালিত হতে থাকে। স্বাধীনতা-উত্তর কালে সংস্কৃতি অঙ্গনে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়। বর্তমানে বাংলা নববর্ষ জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের বকুল তলার প্রভাতী অনুষ্ঠানেও নববর্ষকে সম্ভাষণ জানানো হয়।

স্থানটির পরিচিতি বটমূল হলেও প্রকৃত পক্ষে যে গাছের ছায়ায় মঞ্চ তৈরি হয় সেটি বটগাছ নয়, অশ্বত্থ গাছ। ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠির নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা। পাকিস্তান সরকারের এই অন্যায় আচরণের জবাব দিতেই  “ছায়ানট” ১৯৬৫ সালের ১৪ এপ্রিল (১লা বৈশাখ, বাংলা ১৩৭২ সন) রমনার বটমূলে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “এসো হে বৈশাখ এসো এসো” গানটি দিয়ে সর্বপ্রথম যাত্রা শুরু করে। বস্তুত এই দিনটি থেকেই “পহেলা বৈশাখ”  বাঙালী সংস্কৃতির অন্যতম এক পরিচায়ক রূপ ধারণ করে। ১৯৭২ সালে (বাংলা ১৩৭৯ সন) ‘পহেলা বৈশাখ’ বাংলাদেশের জাতীয় পার্বন হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবার আগ পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার ২১ ফেব্রুয়ারির মতোই থামিয়ে দিতে চেয়েছিল বৈশাখের উদযাপন।

নববর্ষকে উৎসব মুখর করে তোলে বৈশাখী মেলা। এটি মূলত সর্বজনীন লোকজমেলা। কয়েকটি গ্রামের মিলিত এলাকায়, কোনো খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার। এ মেলা অত্যন্ত আনন্দ ঘন হয়ে থাকে। মেলাতে থাকে নানা রকম কুটির শিল্পজাত সামগ্রীর বিপণন, থাকে নানা রকম পিঠাপুলির আয়োজন। স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য, কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, সব প্রকার হস্ত শিল্পজাত ও মৃৎশিল্পজাত সামগ্রী এই মেলায় পাওয়া যায়। এছাড়া শিশু-কিশোরদের খেলনা, মহিলাদের সাজ-সজ্জার সামগ্রী এবং বিভিন্ন লোকজ খাদ্যদ্রব্য যেমন : চিড়া, মুড়ি, খৈ, বাতাসা, বিভিন্ন প্রকার মিষ্টি প্রভৃতির বৈচিত্রময় সমারোহ থাকে মেলায়। থাকে বিনোদনের ব্যবস্থাও। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকগায়ক ও লোকনর্তকরা উপস্থিতি থাকে। তারা যাত্রা, পালা গান, কবি গান, জারি গান, গম্ভীরা গান, গাজীর গান, আলকাপ গানসহ বিভিন্ন ধরণের লোকসঙ্গীত, বাউল-মারফতি-মুর্শিদি-ভাটিয়ালি ইত্যাদি আঞ্চলিক গান পরিবেশন করেন। লাইলী-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, রাধা-কৃষ্ণ প্রভৃতি আখ্যানও উপস্থাপিত হয়। চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, নাটক, পুতুল নাচ, নাগর দোলা, সার্কাস ইত্যাদি মেলার বিশেষ আকর্ষণ। এছাড়া শিশু-কিশোরদের আকর্ষণের জন্য থাকে বায়োস্কোপ। শহরাঞ্চলে নগর সংস্কৃতির আমেজেও এখন বৈশাখী মেলা বসে এবং এই মেলা বাঙালিদের কাছে এক অনাবিল মিলন মেলায় পরিণত হয়।

বৈশাখী মেলা বাঙালির আনন্দ ঘন লোকায়ত সংস্কৃতির ধারক। এই দিনের একটি পুরনো সংস্কৃতি হলো গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন। এর মধ্যে নৌকা বাইচ, লাঠি খেলা কিংবা কুস্তি এক সময় প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশে এরকম কুস্তির সবচেয়ে বড় আসরটি হয় ১২বৈশাখ, চট্টগ্রামের লালদিঘী ময়দানে, যা জব্বারের বলি খেলা নামে পরিচিত।

বাংলাদেশের যেসব স্থানে বৈশাখী মেলা বসে সেসবের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হলো :  নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সাভার, রংপুরের পায়রাবন্দ, দিনাজপুরের ফুলছড়ি ঘাট এলাকা, মহাস্থানগড়, কুমিল্লার লাঙ্গলকোট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মহেশপুর, খুলনার সাতগাছি, ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল অঞ্চল, সিলেটের জাফলং, মণিপুর, বরিশালের ব্যাসকাঠি-বাটনাতলা, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, টুঙ্গিপাড়া ও মুজিবনগর এলাকা। ঢাকার নিকটবর্তী শুভাঢ্যার বৈশাখী মেলা, টঙ্গীর স্নানকাটা মেলা, মিরপুর দিগাঁও মেলা, সোলারটেক মেলা, শ্যামসিদ্ধি মেলা, ভাগ্যকুল মেলা, কুকুটিয়া মেলা এবং রাজ নগর মেলা উল্লেখযোগ্য। দিনাজপুরের ফুলতলী, রাণীশংকৈল, রাজশাহীর শিবতলীর বৈশাখী মেলাও বর্তমানে বিরাট উৎসবের রূপ নিয়েছে।

কালের বিবর্তনে নববর্ষের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক পুরানো উৎসবের বিলুপ্তি ঘটেছে, আবার সংযোগ ঘটেছে অনেক নতুন উৎসবের। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে পুণ্যাহ উৎসবের বিলুপ্তি ঘটে। তখন পহেলা বৈশাখ ছিল জমিদারদের পুণ্যাহের দিন। ঢাকার ঘুড়ি ওড়ানো এবং মুন্সিগঞ্জের গরুর দৌড় প্রতিযোগিতা ছিল একসময় অত্যন্ত জাঁকজমক পূর্ণ। কিন্তু এদুটিসহ ঘোড়দৌড়, ষাড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, পায়রা ওড়ানো, নৌকা বাইচ, বহু রূপীর সাজ ইত্যাদি গ্রাম বাংলার জন প্রিয় খেলা বর্তমানে আর তেমন প্রচলিত নেই। বর্তমানে প্রচলিত বিভিন্ন আঞ্চলিক অনুষ্ঠানের মধ্যে চট্টগ্রামের বলী খেলা এবং রাজশাহীর গম্ভীরা প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনায় অনুষ্ঠিত হয়।

বর্তমানে নগর জীবনে নগর-সংস্কৃতির আদলে অত্যন্ত জাঁকজমক পূর্ণভাবে নববর্ষ উৎযাপিত হয়। এদিন সাধারণত সব শ্রেণীর এবং সব বয়সের মানুষ ঐতিহ্যবাহী বাঙালি পোশাক পরিধান করে। নববর্ষকে স্বাগত জানাতে তরুণীরা লাল পেড়ে সাদা শাড়ি, হাতে চুড়ি, খোপায় ফুল, গলায় ফুলের মালা এবং কপালে টিপ পরে; আর ছেলেরা পরে পাজামা ও পাঞ্জাবি। কেউ কেউ ধুতি- পাঞ্জাবিও পরে। এদিন সকাল বেলা পান্তা ভাত খাওয়া একটি ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। সঙ্গে থাকে ইলিশ মাছ ভাজা।

মঙ্গল শোভাযাত্রা :

ঢাকার বৈশাখী উৎসবের একটি আবশ্যিক অঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। এখানকার চারু শিল্পীদের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা নববর্ষের আহবানকে করে তোলে নয়ন মনোহর এবং গভীর আবেদনময়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখের সকালে এই শোভাযাত্রাটি বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসে শেষ হয়। এই শোভাযাত্রায় গ্রামীণ জীবন এবং আবহমান বাংলাকে ফুটিয়ে তোলা হয়। শোভাযাত্রায় সকল শ্রেণী-পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে। শোভাযাত্রার জন্য বানানো হয় বিভিন্ন রঙের মুখোশও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি। এদিন শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ, টি.এস.সি এবং চারুকলাসহ সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পরিণত হয় এক বিশালজন সমুদ্রে। এ শোভাযাত্রা উপভোগ করে সব শ্রেণীর আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। ১৯৮৯ সাল থেকে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা পহেলা বৈশাখ উৎসবের একটি অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

বউ মেলা :

ঈশাখাঁর সোনারগাঁওয়ে ব্যতিক্রমী এক মেলা বসে যার নাম ‘বউমেলা’। এটি স্থানীয়ভাবে “বটতলার মেলা”  নামেও পরিচিত। জয় রামপুর গ্রামের মানুষের ধারণা, প্রায় ১০০ বছর ধরে পহেলা বৈশাখে শুরু হওয়া এই মেলা পাঁচ দিনব্যাপী চলে। প্রাচীন একটি বটবৃক্ষের নিচে এই মেলা বসে, যদিও সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সিদ্ধেশ্বরী দেবীর পুজোর জন্য এখানে সমবেত হয়। বিশেষ করে কুমারী, নববধূ, এমনকি জননীরা পর্যন্ত তাঁদের মনস্কামনা পূরণের আশায় এই মেলায় এসে পূজা-অর্চনা করেন। সন্দেশ-মিষ্টি-ধান-দূর্বার সঙ্গে মৌসুমি ফলমূল নিবেদন করে ভক্তরা। পাঁঠা বলির রেওয়াজও পুরনো। তবে বদলে যাচ্ছে ঐসব পুরনো অর্চনার পালা। এখন কপোত-কপোতি উড়িয়ে দেবীর কাছ থেকে শান্তির বার্তা পেতে চায় ভক্তরা।

ঘোড়া মেলা :

এছাড়া সোনারগাঁ থানার পেরাব গ্রামের পাশে আরেকটি মেলার আয়োজন করা হয়। এটির নাম ঘোড়া মেলা। লোক মুখে প্রচলিত যামিনী সাধক নামের এক ব্যক্তি ঘোড়ায় করে এসে নববর্ষের এইদিনে সবাইকে প্রসাদ দিতেন এবং তিনি মারা যাওয়ার পর ওই স্থানেই তাঁর স্মৃতিস্তম্ভ বানানো হয়। প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে স্মৃতিস্তম্ভে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা একটি করে মাটির ঘোড়া রাখে এবং এখানে মেলার আয়োজন করা হয়। একারণে লোক মুখে প্রচলিত মেলাটির নাম ঘোড়া মেলা। এমেলার অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে নৌকায় খিচুড়ি রান্না করে রাখা হয় এবং আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই কলা পাতায় আনন্দের সঙ্গে তা ভোজন করে। সকাল থেকেই এস্থানে লোকজনের আগমন ঘটতে থাকে। শিশু-কিশোররা সকাল থেকেই উদগ্রীব হয়ে থাকে মেলায় আসার জন্য। একদিনের এমেলাটি জমে ওঠে দুপুরের পর থেকে। হাজারো লোকের সমাগম ঘটে। যদিও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কারণে এমেলার আয়োজন করা হয়। তথাপি সব ধর্মের লোকজনেরই প্রাধান্য থাকে এমেলায়। এমেলায় শিশু-কিশোরদের ভিড় বেশি থাকে। মেলায় নাগর দোলা, পুতুল নাচ ও সার্কাসের আয়োজন করা হয়। নানা রকম আনন্দ-উৎসব করে পশ্চিমের আকাশ যখন রক্তিম আলোয় সজ্জিত উৎসবে, যখন লোকজন অনেকটাই ক্লান্ত, তখনই এমেলার ক্লান্তি দূর করার জন্য নতুন মাত্রায় যোগ হয় কীর্তন। একীর্তন হয় মধ্যরাত পর্যন্ত। এভাবেই শেষ হয় বৈশাখের এই ঐতিহ্যবাহী মেলা।

চট্টগ্রামে বর্ষবরণ

চট্টগ্রামের ডিসি হিল প্রাঙ্গনে পহেলা বৈশাখ উদযাপন

বন্দরনগরী চট্টগ্রামে পহেলা বৈশাখের উৎসবের মূল কেন্দ্র ডিসি হিল পার্ক। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে প্রতি বছর এখানে পুরনো বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে বরণ করার জন্য দুইদিনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। সি আর বি-তে মুক্ত মঞ্চে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি থাকে নানা গ্রামীণ পন্যের পশরা। নগরীর অন্যান্য নিয়মিত আয়োজনের মধ্যে রয়েছে শিশু সংগঠন ফুলকীর তিনদিন ব্যাপী উৎসব যা শেষ হয় বৈশাখের প্রথম দিবসে। নগরীর বাংলাদেশ মহিলা সমিতি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে বর্ষবরণ মেলার আয়োজন হয়ে থাকে। এছাড়াও থাকে পান্তা ইলিশের ব্যবস্থা।

চট্টগ্রামে সম্মিলিতভাবে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের উদ্যোগ ১৯৭৩, ১৯৭৪ ও ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিকগণের চেষ্টায় ইস্পাহানী পাহাড়ের পাদদেশে এই অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। ১৯৭৮ সালে প্রথম বাবের মতো এই উৎসব এখনকার ডিসি হিল পার্কে সরিয়ে নেওযা হয়। প্রথম দিকে প্রত্যেক সংগঠন থেকে দুইজন করে নিয়ে একটি স্কোয়াড গঠন করা হত এবং সেই স্কোয়াডই সম্মিলিত সঙ্গীত পরিবেশন করতো। ১৯৮০ সাল থেকে সংগঠনগুলো আলাদা ভাবে গান পরিবেশন শুরু করে। পরে গ্রুপ থিয়েটার সমন্বয় পরিষদ যুক্ত হওয়ার পর অনুষ্ঠানে নাটক ও যুক্ত হয়েছে।

পার্বত্য জেলায়, আদিবাসীদের বর্ষবরণ

বাংলা নববর্ষ ও চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে তিন পার্বত্য জেলায় (রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি)  উপজাতীয়দের ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয়- সামাজিক উৎসব ‘বৈসাবি’আনন্দ মুখর পরিবেশে পালিত হয়। বৈসাবি হলো পাহাড়ীদের সবচেয়ে বড় উৎসব। এ উৎসবকে ত্রিপুরারা বৈশুক, মারমারা সাংগ্রাই এবং চাকমারা বিজু বলে আখ্যা দিলেও গোটা পার্বত্য এলাকায় ‘বৈসাবি’নামেই পরিচিত। বৈশুক, সাংগ্রাই ও বিজু এই নামগুলির আদ্যক্ষর নিয়ে বৈসাবি শব্দের উৎপত্তি। বছরের শেষ দুদিন এবং নতুন বছরের প্রথম দিন এতিনদিন মিলেই মূলত বর্ষবরণ উৎসব ‘বৈসবি’পালিত হয়। পুরানো বছরের বিদায় এবং নতুন বছরকে বরণ উপলক্ষে পাহাড়ীরা তিন দিনব্যাপী এ বর্ষবরণ উৎসব সেই আদিকাল থেকে পালন করে আসছে। এ উৎসব উপলক্ষে পাহাড়ীদের বিভিন্ন খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আদিবাসী মেলার আয়োজন করা হয়। আর মারমা উপজাতীয়রা আয়োজন করে ঐতিহ্যবাহী ওয়াটার ফেস্টিবল বা পানি খেলা। পানিকে পবিত্র তার প্রতীক ধরে নিয়ে মারমারা তরুণ- তরুণীদের পানি ছিটিয়ে পবিত্র ও শুদ্ধকরে নেয়। পাহাড়ীদের মধ্যে পানি উৎসবটি অত্যন্ত জনপ্রিয়।

পশ্চিমবঙ্গ

পশ্চিমবঙ্গে মহা সমারোহে সাড়ম্বরে উদযাপিত হয় বাংলা নববর্ষারম্ভ পয়লা বৈশাখ। বঙ্গাব্দের প্রথম দিনটিতে বিপুল উৎসাহ এবং উদ্দীপনার সাথে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়ে থাকে সমগ্র পশ্চিম বাংলায়। বাংলার গ্রামীণ এবং নাগরিক জীবনের মেল বন্ধন সাধিত হয়ে সকলে এক সূত্রে বাঁধা পড়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর আনন্দে। সারা চৈত্র মাস জুড়েই চলতে থাকে বর্ষবরণের প্রস্তুতি। চৈত্র মাসের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তি বা মহা বিষুব সংক্রান্তির দিন পালিত হয় গাজন উৎসব উপলক্ষ্যে চড়ক পূজা অর্থাৎ শিবের উপাসনা। এই দিনেই সূর্যমীন রাশি ত্যাগ করেমেষ রাশিতে প্রবেশ করে। এদিন গ্রাম বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে আয়োজিত হয় চড়ক মেলা। এই মেলায় অংশ গ্রহণকারী সন্ন্যাসী বা ভক্তগণ বিভিন্ন শারীরিক কসরৎ প্রদর্শন করে আরাধ্য দেবতার সন্তোষ প্রদানের চেষ্টা এবং সাধারণ মানুষের মনোরঞ্জন করে থাকেন।

কলকাতা

ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতা পয়লা বৈশাখ উদযাপনে একটি অন্যতম গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। নববর্ষারম্ভ উপলক্ষে শহরের বিভিন্ন পাড়ার অলিতে গলিতে নানা সংগঠনের উদ্যোগে প্রভাত ফেরি আয়োজিত হয়। বিগত বছরের চৈত্র মাসে শহরের অধিকাংশ দোকানে ক্রয়ের উপর দেওয়া হয়ে থাকে বিশেষ ছাড়, যার প্রচলিত কথ্যনাম ‘চৈত্র সেল’। তাই পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে এবং এই ছাড়ের সুবিধা গ্রহণ করতে অর্থনৈতিক অবস্থা নির্বিশেষে কলকাতার সমস্ত মানুষ এক মাস ধরে নতুন জামা কাপড়, ইত্যাদি ক্রয় করে থাকে।

পয়লা বৈশাখের দিন উল্লেখযোগ্য ভিড় চোখে পড়ে কলকাতার বিখ্যাত কালীঘাট মন্দিরে। সেখানে বিভিন্ন ব্যবসায়ী ভোর থেকে মন্ত্রপাঠ পূর্বক গঙ্গাস্নান করে প্রতীক্ষা করে থাকেন দেবীকে পূজা নিবেদন করে হালখাতা আরম্ভ করার জন্য। ব্যবসায়ী ছাড়াও বহু গৃহস্থ ও পরিবারের মঙ্গল কামনা করে দেবীর আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে কালীঘাটে গিয়ে থাকেন। এই দিন বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পোশাক হিসাবে নতুন ধুতি- পাঞ্জাবি এবং শাড়ি পরার রেওয়াজ প্রচলিত।

অন্যান্য দেশে পহেলা বৈশাখ

বাংলাদেশ এবং ভারত ছাড়াও পৃথিবীর আরো নানান দেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হয়ে থাকে। মূলত প্রবাসী বাঙ্গালীরা সেসব দেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে থাকেন।

অস্ট্রেলিয়া

অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শহরে যেমন :সিডনি, মেলবোর্ন, ক্যানবেরাতে বৈশাখী মেলার মাধ্যমে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হয়। বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ নাচ-গান-ফ্যাশন শো- খাবারের মাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতির এধারাকে আনন্দময় করে তোলে। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে সর্ববৃহৎ বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হয়। আগে বার্নউড বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হলে ও ২০০৬ সাল থেকে সিডনি অলিম্পিক পার্কে মেলাটি অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মেলায় বিপুল পরিমাণ লোকের সমাগম ঘটে এবং প্রবাসী বাঙালিদের জন্য এটি একটি আনন্দ ঘন দিন।

সুইডেন

সুইডেনে ও বিপুল উৎসাহের সাথে পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হয়।

ইংল্যান্ড

ইংল্যান্ডে অবস্থানকারী প্রবাসী বাঙালিরা স্ট্রিট ফেস্টিভ্যাল (পথ উৎসব) পালন করে। এই উৎসবটি লন্ডনে করা হয়। ইউরোপে অনুষ্ঠিত সর্ববৃহৎ এশীয় উৎসব এটি এবং বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া সর্ববৃহৎ বাঙালি উৎসব।

বঙ্গাব্দের বারো মাসের নামকরণ :

বঙ্গাব্দের বারো মাসের নামকরণ করা হয়েছে নক্ষত্র মন্ডলে চন্দ্রের আবর্তনে বিশেষ তারার অবস্থানের উপর ভিত্তি করে। বাংলা মাসের এই নাম গুলি হচ্ছে :

  • বৈশাখ – বিশাখা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
  • জ্যৈষ্ঠ – জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
  • আষাঢ় – উত্তর ও পূর্ব আষাঢ়া নক্ষত্রের নাম অনুসারে
  • শ্রাবণ – শ্রবণা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
  • ভাদ্র – উত্তর ও পূর্ব ভাদ্রপদ নক্ষত্রের নাম অনুসারে
  • আশ্বিন – অশ্বিনী নক্ষত্রের নাম অনুসারে
  • কার্তিক – কৃত্তিকা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
  • অগ্রহায়ণ (মার্গশীর্ষ) – মৃগশিরা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
  • পৌষ – পুষ্যান ক্ষত্রের নাম অনুসারে
  • মাঘ – মঘা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
  • ফাল্গুন – উত্তর ও পূর্ব ফাল্গুনীন ক্ষত্রের নাম অনুসারে
  • চৈত্র – চিত্রা নক্ষত্রের নাম অনুসারে

সম্রাট আকবর কর্তৃক প্রবর্তিত তারিখ-ই-ইলাহী-র মাসের নামগুলি প্রচলিত ছিল ফারসি ভাষায়, যথা: ফারওয়াদিন, আর্দি, ভিহিসু, খোরদাদ, তির, আমারদাদ, শাহরিযার, আবান, আযুর, দাই, বহম এবং ইসক্নদার মিজ।

বাংলাদিনেরনামকরণ :

বাংলা সন অন্যান্য সনের মতোই সাতদিনকে গ্রহণ করেছে এবং এদিনের নাম গুলো অন্যান্য সনের মতোই তারকা মন্ডলীর উপর ভিত্তি করেই করা হয়েছে।

  • রবিবার হচ্ছে রবি বা সূর্য দেবতার নাম অনুসারে
  • সোম বার হচ্ছে সোম বা শিব দেবতার নাম অনুসারে
  • মঙ্গলবার হচ্ছে মঙ্গল গ্রহের নাম অনুসারে
  • বুধবার হচ্ছে বুধ গ্রহের নাম অনুসারে
  • বৃহস্পতিবার হচ্ছে বৃহস্পতি গ্রহের নাম অনুসারে
  • শুক্রবার হচ্ছে শুক্র গ্রহের নাম অনুসারে
  • শনিবার হচ্ছে শনি গ্রহের নাম অনুসারে

বাংলা সনে দিনের শুরু ও শেষ হয় সূর্যোদয়ে। ইংরেজি বা গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির শুরু হয় যেমন মধ্যরাত হতে।

উৎসবকে কেন্দ্র করে আমাদের নীতি ও নৈতিকতা এর প্রতিফলন :

আমাদের বংলাদেশে এখন মানুষের নীতি-নৈতিকতা, সামাজিক মুল্যবোধ, অপরকে সম্মান প্রধান করা, নারীকে সম্মান প্রধান করা, ইতিহাস ও ঐতিহ্য এর কোনো মূল্য নাই। উৎসব পালনে সবার জন্য সুন্দর ও অনুকুল পরিবেশ চাই।

নতুন বছরের উৎসবের সঙ্গে গ্রামীণজন গোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় যোগাযোগ। গ্রামে মানুষ ভোরে ঘুম থেকেওঠে, নতুন জামা কাপড় পরে এবং আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যায়। এছাড়াও বিভিন্ন বৈশাখী মেলা, বলি খেলা, পান্তা ইলিশ, নৌকা বাইচ, লাঠিখেলা ইত্যাদি উপভোগ করতে গিয়ে সমাজের কিছু প্রগতিশীল মুক্তমনা মানুষের হাতে আমাদের মা-বোনেরা লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছে। প্রতি উৎসবকে কেন্দ্র করে মা-বোনদের লাঞ্ছনা করা, বিভিন্ন পার্কে ঘুরতে যাবার নাম করে ছেলে-মেয়েদের অনৈতিক আচরণ, যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন অপকর্ম সংঘটিত হচ্ছে এর দায়কে নেবে। আমরা যদি শিকড়কে ভুলে যাই তাহলে আমাদের ধ্বংস খুব নিকটে। আমরা উৎসব পালন করব নিয়ন-শৃঙ্খলা ও ইতিহাসকে সামনে রেখে। উগ্র ও হৈচৈপূর্ণ ভাবে আমরা উৎসব পালন করব না বরং সুশৃঙ্খলভাবেসার্বিকআনন্দের মাধ্যমেউৎসব পালন করব।

মঙ্গল শোভাযাত্রা এর সময় নারীদের যৌন হয়রানি না করা, বৈশাখী মেলা, বলি খেলা ইত্যাদি অনুষ্ঠানে অশ্লীলতা বর্জন করা, জুয়া এর আসর না বসানো, নাগর দোলা ও পুতুল নাচ এর নামে নগ্ন নাচনা করা, পান্তা-ইলিশ খেয়ে একদিনের বাঙ্গালীনা হওয়া বরং নিজের মধ্যে বাঙ্গালী মনোভাব জাগ্রত করা। উগ্রতা পরিহার করা।

পরিশেষে :

‘ময়মনসিংহ গীতিকা’য় বাংলা নববর্ষের আবাহন ধ্বনিত হয়েছে “আইল নতুন বছর লইয়া নব সাজ, কুঞ্জে ডাকে কোকিল-কেকা বনে গন্ধরাজ”। মোটামোটি ভাবে এই হল আমাদের বাঙালী ঐতিহ্য,  এটাই হল আমাদের বৈশাখের ঐতিহ্য, যেকোনো বাধা বিপত্তি পেরিয়ে, সহ¯্র প্রতিকূলতা ছাড়িয়ে, রাষ্ট্রীয় অস্থিতিশীল তার মাঝেও আমাদেরকেমাতিয়ে তোলে বর্ষবরণ উদযাপন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর পঙ্কটি দিয়ে শেষ করছি :

“রসের আবেশ রাশি

শুষ্ক করি দাও আসি,

আনোআনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ

মায়ার কুজ্ঝটি জাল যাক দূরে যাক”

Comments